কলকাতা ছাড়িয়ে বনেদি বাড়ির পুজোর সুলুক সন্ধান-পঞ্চম পর্ব

কলকাতা ছাড়িয়ে বনেদি বাড়ির পুজোর সুলুক সন্ধানে আজকের পর্বে টেরাকোটা প্রসিদ্ধ, স্বামী বিবেকানন্দের পদধূলিতে হুগলি জেলার অন্যতম প্রাচীন জনপদ আঁটপুরের ২৯১ বছরের  ছোটো ঘোষ বাড়ির দূর্গাপূজা সম্পর্কে আলোকপাত করলেন সংবাদ প্রতিখনের প্রতিনিধি আত্রেয়ী দো

 

আঁটপুর ছোটো ঘোষ বাড়ির দূর্গাপূজা

আজ আমরা কথা বলব হুগলী জেলার শ্রীরামপুর মহকুমার জাঙ্গীপাড়া থানার অন্তর্ভুক্ত আঁটপুর ঘোষ বাড়ির দূর্গাপূজা নিয়ে। এবার এই পুজো ২৯১তম বর্ষে পা দিল। এই বাড়িতে প্রথম দূর্গাপূজা শুরু করেন এই পরিবারেরই ২১তম পুরুষ রামধন ঘোষ। তিনি মেদিনীপুরের নিমকমহলে কর্মরত অবস্থায় প্রচুর সম্পদ অর্জন করেন এবং তারপর থেকে এই পুজোর প্রচলন করেন। ১১৩৯ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৭৩২ খ্রীস্টাব্দ থেকে এই পুজো শুরু হয়। প্রথম দিকে কাঠ, বাঁশ ও খড়ের সাবেক প্রথায় আটচালা ছিল,পরে তা জীর্ণ হয়ে যাওয়ায় ১২৫৫ বঙ্গাব্দে বর্তমান কড়ি বরগার পাকা দালান নির্মিত হয়। জন্মাষ্টমীর দিন প্রতিমা নির্মাণের জন্য দীঘির পারের মাটি সংগ্রহ করে,কাঠামো পূজা করে প্রতিমা নির্মাণ শুরু হয়।

তদানীন্তন কালের পুজোর আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে বর্তমানের কিছু পার্থক্য ঘটলেও প্রতিমার আকারের কোনো রদ-বদল হয়নি। এই বাড়িতে বংশানুক্রমিকভাবে, একচালার প্রতিমা ডাকের সাজে সজ্জিতা হয়ে পূজিত হন। এই বাড়ির প্রতিমার আদল হল, একচালার মধ্যে ওপরের দিকে দূর্গা মায়ের দুই পাশে থাকে গণেশ ও কার্তিক এবং নীচের দিকে থাকে লক্ষী ও সরস্বতী। এখানে, মহালয়ার পরদিন অর্থাৎ প্রতিপদ থেকেই শুরু হয়ে যায় দেবীর আবাহন। এই বাড়ির দূর্গাপূজা হয় শাক্ত রীতি মেনে। পূর্বে এই পুজোয় পাঠাবলির প্রচলন ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে এই প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এখানে চালকুমড়ো, আখ গাছ, আদা গাছ, গোঁড়া লেবু, কাঠালি কলা ইত্যাদি বলি দেওয়ার চল রয়েছে।এই বাড়ির প্রতিষ্ঠিত কূলদেবতা ঈশ্বর রাজরাজেশ্বর জিঊ এখানে নিত্যপূজিত হন। ষষ্ঠীর দিন দেবীর বোধনের পর কূলদেবতাকে তার শয়নকক্ষ থেকে নিয়ে এসে দূর্গাপ্রতিমার পাশে আসনে বসিয়ে পূজা করা হয় এবং রাত্রে আবারও তাঁর শয়নকক্ষে রেখে আসা হয়।পুজোর চারদিনই মা দূর্গার সাথে সাথে কূলদেবতাও পূজিত হন। এখানে সপ্তমী, সন্ধিপূজা এবং নবমী তিন সময়ে তিনবার বলির প্রচলন রয়েছে। সপ্তমীতে এবং সন্ধিপূজায় দুই খানি করে

চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। নবমীতে নয়টি বলি দেওয়া হয় – দুটি চালকুমড়ো, দুটি আদা গাছ, দুটি আখ গাছ, দুটি গোঁড়া লেবু এবং একটি কাঠালি কলা। সন্ধি পূজার ১০৮টি প্রদীপের আরতি, ১০৮টি পদ্মের পুষ্পার্ঘ্য, নবমীতে কুমারী পূজা, হোম থেকে শুরু করে ধূনী পোড়ানো প্রতিটি পূজার আচার অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালিত হয়। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলারা মাথায় মাটির সরা নেন। তার আগে মোটা গামছা বেঁধে তার ওপর ধুনুচি বা মাটির সরা বসানো হয়। তাতে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হতে থাকে। দুই হাতেও সড়া থাকে। সেই মহিলার কোলে তাঁর পুত্র বা নিকট আত্মীয় বালক বা বালিকা বসে। ধূনী পোড়ানোর মাধ্যমে মা দূর্গার কাছে প্রার্থনা নিবেদন করা হয় পরিবারের মঙ্গল কামনার জন্য।

দশমীর দিন দুপুরে দুর্গাদালানের পিছনে ‘নতুন দিঘী’তে ঘট ভাসান দেওয়া হয়। সন্ধ‍্যায় স্থানীয় হাটপুকুরে কাহারারা মাকে কাধে করে নিয়ে গিয়ে ভাসান দেয়। এখন অবশ‍্য টেম্পো করে ঠাকুর নিয়ে যাওয়া হয়। ভাসান শেষে দালানে ফিরে সকলে নতুন পোশাক পরে শান্তিজল নেয় এবং কলাপাতার ওপরে বেলপাতার ডাটা আলতায় ডুবিয়ে তিনবার মায়ের নাম লেখা হয়-“শ্রী শ্রী দুর্গামাতা সহায়”। তারপর একে অপরকে প্রণাম কোলাকুলি ও মিষ্টিমুখের মাধ্যমে দশমী সারে। প্রতিমা যে ঘাটে বিসর্জন করা হয় সেই পুকুরের জলকে স্থানীয় মানুষেরা পবিত্র বলে মনে করে। তাদের বিশ্বাস ঐ জলে স্নান করলে অসুখ সেরে যায়। কোনো অজানা কারণে ঘোষবাড়ির পূজায় বড় ঝোলানো ঘন্টা ও ঘড়ি বাজানো নিষেধ।

error: Content is protected !!

Discover more from Sambad Pratikhan

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading