এবার ক্যালোরি ছাড়াই মিষ্টিমুখ

আত্রেয়ী দো: বাঙালির শেষ পাতে মিষ্টি থাকবে না তা কি হয়? তবে ওই যে কথায় আছে না ‘মিছরির ছুরি’! স্বাদে মিষ্টি হলেও শরীরের জন্য মিষ্টি যে কতখানি ক্ষতিকর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তা সত্ত্বেও মিষ্টির জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়েনি। কিন্তু ডায়াবেটিক রোগীরা একপ্রকার বাধ্য হয়েই মিষ্টি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকেন। শুধু তাই নয় স্বাস্থ্য সচেতনকারীরাও বহু কষ্টে মিষ্টির লোভ সংবরণ করে থাকেন। এই সমস্যারও রয়েছে সমাধান। আজ কথা বলব স্টেভিয়া নামক একটি মিষ্টি গুল্ম জাতীয় ভেষজ উদ্ভিদ নিয়ে। এই গাছকে মধু গাছ বা হিন্দিতে মিঠি তুলসীও বলা হয়ে থাকে।

প্যারাগুয়ের গুরানী ইন্ডিয়ান উপজাতিরা এই গাছকে বল-কা-হি-হি বলে থাকেন যার অর্থ মধু গাছ। আফ্রিকাতে এই গাছের পাতা মধু বা চিনি পাতা নামে পরিচিত। জাপানে এই গাছের নাম আমহা সুটেবিয়া, থাইল্যান্ডে নাম মিষ্টি ঘাস। ভারতের অনেক জায়গায় স্টেভিয়া গাছটি মধু পারানি নামেও পরিচিত। ১৮৮৭ সালে সুইজারল্যান্ডের একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ডক্টর এম.এস.বার্টনি প্রথম এই গাছটির গুণাবলী সম্পর্কে আলোকপাত করেন। অনেক বছর আগে থেকেই প্যারাগুয়ের পার্বত্য অঞ্চল রিওমন্ডে এই স্টেভিয়া গাছের চাষ করা হতো। ১৯৬৪ সালে প্যারাগুয়েতে বাণিজ্যিকভাবে স্টেভিয়া চাষ শুরু হয়। তার কিছুদিন পর ১৯৬৮ সালের দিকে জাপানেও এই গাছের চাষ শুরু হয়। তারপর ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া ইত্যাদি জায়গায় বাণিজ্যিকভাবে স্টেভিয়া গাছের চাষ শুরু হয়।

গাছটির বিজ্ঞানসম্মত নাম হল-স্টেভিয়া রেবান্ডিয়ানা। গাছটি বহুবর্ষজীবী এবং এর উচ্চতা প্রায় ৪৫ সেন্টিমিটার অবধি হয়ে থাকে। এই গাছের ফুলগুলি সাদা রঙের হয়ে থাকে। স্টেভিয়া গাছের পাতায় স্টেভিওসাইড নামক একটি উপাদান থাকে,যা সুক্রোজের থেকে প্রায় ৩০০ গুন বেশি মিষ্টি। অপ্রক্রিয়াজাত অবস্থায় স্টেভিয়া গাছের পাতা চিনির চেয়ে প্রায় ২০-৩০ গুণ বেশি মিষ্টি। প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিশুদ্ধ করার পরে এটি চিনির চেয়ে প্রায় ২৫০-৩০০ গুণ বেশি মিষ্টি। ৫০ গ্রাম স্টেভিয়া পাউডার প্রায় ১০০০ গ্রাম চিনির সমতুল্য। স্টেভিয়া একটি প্রাকৃতিক মিষ্টি উপাদান। এতে চিনির থেকে বেশি মিষ্টতা থাকলেও কোনো ক্যালোরি নেই। তাই ওজন বৃদ্ধির কোন সম্ভাবনা নেই। ডায়াবেটিক রোগীরাও এই নন-ক্যালোরিক মিষ্টি খেতে পারেন।

 

স্টেভিয়াতে থাকে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন সি ইত্যাদি। এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সাহায্য করে এবং সেই সাথে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন ক্ষরণে সাহায্য করে ফলে রক্তশর্করার মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকে। স্টেভিয়াতে রয়েছে অ্যান্টিফাঙ্গাল এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ। স্টেভিয়া সেবনে হজম জনিত কোনো সমস্যা হয়না। এটি দাঁতের ক্ষয়,ক্যাভিটি জনিত সমস্যা থেকে দূরে রাখে। স্টেভিওসাইড উচ্চ তাপমাত্রা এবং অ্যাসিডিক কিংবা ক্ষারীয় উভয়ে মাধ্যমেই স্টেবল থাকে। তাই এটি দীর্ঘদিন পর্যন্ত নিরাপদে ব্যবহার করা যায়।

চকলেট, ক্যান্ডি তৈরীতে স্টেভিয়া ব্যবহার করা যেতে পারে। স্টেভিয়া গাছের পাতার মিষ্টি গন্ধ মুখের মধ্যে প্রায় এক ঘন্টা অবধি মিষ্টত্ব বজায় রাখে, তাই চিউয়িং গাম, মিন্ট, মাউথ রিফ্রেশনার, পান ইত্যাদি প্রস্তুতিতেও এই পাতা ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া স্কোয়াস, টফি ইত্যাদি প্রস্তুতিতেও স্টেভিয়া ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। সমস্ত রান্না, বেকড আইটেম যেমন পুডিং, কেক, নানান ধরনের ডেজার্ট তৈরিতে চিনির পরিবর্তে স্টেভিয়া ব্যবহার করা যেতে পারে। চিনির থেকে এটি পরিমাণেও লাগে কম এবং মিষ্টত্বও অনেক বেশি। স্টেভিওসাইড ননফর্মেন্টিং এবং এটি ব্যবহারে রান্নার বর্ণের কোনো রকম পরিবর্তন হয় না। তবে ভালো দিকের সাথে সাথে রয়েছে কিছু খারাপ দিকও।

স্টেভিয়া চিনি সহ অন্যান্য কৃত্রিম মিষ্টির চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি ব্যয়বহুল। এটি সেবনে বমি-বমি ভাব, ফুলে যাওয়া এবং গ্যাসের মত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হতে পারে। স্টেভিয়ার একটি লিকোরিস গন্ধ রয়েছে এবং এর ফলে কিছুটা তিক্ত স্বাদ অনুভূত হতে পারে।

তবে বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গেছে, স্টেভিয়া সেবন নিরাপদ। এটি অকার্সেনোজেনিক এবং এতে আসক্তি জন্মায়না। স্টেভিয়া ফিনাইলকেটোনুরিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য উপযুক্ত। এটি ভারত সরকার দ্বারা অনুমোদিত এবং সেই সাথে বিশ্বের আরও ২০টি দেশ স্টেভিয়াকে সমর্থন করেছে। তাহলে চিন্তা না করে এবার মিষ্টি মুখ করুন ক্যালোরি ছাড়াই।

%d bloggers like this: