হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ডের প্রচলন

আজ ৩০ জুলাই, আজকের দিনেই ভারতবাসী হারিয়েছিল ভারতের নব জাগরণের অন্যতম পথিকৃত বাংলা ভাষার পুরোধা পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের অন্যতম একটি কাজ ছিল বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন। বিধবা বিবাহ ছাড়াও তিনি চালু করেছিলেন হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফাণ্ড। বিদ্যাসাগরের তিরোধনের ১৩৩ বর্ষপূর্তিতে হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফাণ্ড সম্পর্কে আলোকপাত করলেন সাংবাদিক কিশলয় মুখোপাধ্যায়

অষ্টমবর্ষীয় কন্যা দান করিলে পিতা মাতার গৌরীদানজন্য পুণ্যোদয় হয়, নবম বর্ষীয়াকে দান করিলে পৃথ্বী দানের ফল লাভ হয়; দশমবর্ষীয়াকে পাত্রসাৎ করিলে পরত্র পবিত্রলোক প্রাপ্তি হয়। ইত্যাদি স্মৃতিশাস্ত্রপ্রতিপাদিত কল্পিত ফলমৃগ তৃষ্ণায় মুগ্ধ হইয়া পরিণাম বিবেচনা পরিশূণ্য চিত্তে তস্মদেশীয় মনুষ্য মাত্রেই বাল্যকালে পাণি পীড়নের প্রথা প্রচলিত করিয়াছেন। ইহাতে এ পর্যন্ত যে কত নিদারুণ অনর্থ সঙ্ঘটন হইতেছে তাহা কাহার না অনুগোচর আছে।’ বাল্য বিবাহের দোষ প্রবন্ধের শুরুর কয়েকটি লাইন।  লিখেছিলেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। ১৮৫০ সালের আগস্ট মাসে ‘সর্বশুভকারী’ মাসিক পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশ পায়। সম্পাদক ছিলেন মতিলাল চট্টোপাধ্যায়। তবে তখন লেখকের নাম উল্লেখ ছিলনা। এই ভাবে তিনি শুরু করেছিলেন বিধবা বিবাহ আন্দোলন। তিনি বলেছিলেন বাল্যবিবাহের জন্যই বিধবা নারীদের সহ্য করতে হত চরম দুর্দশা। এই বিষয় আর্থিক সাহায্যের জন্য ১৮৭২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফাণ্ড। প্রথম দুবছর ট্রাষ্টিতে ছিলেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর আর দ্বারকানাথ মিত্র।

১৮৫৫ সালে ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক প্রস্তাব’ নামে দুটি বই লেখেন। পরাশর সংহিতা থেকে উদ্ধৃতির সাহায্যে তিনি প্রমাণ করেন বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসন্মত। ১৮৫৬ সালে এই বই দুটির ম্যারেজ অফ দা উইডো’স নামে ইংরাজি ভাষায় অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এছাড়া ১৮৬৫ সালে বই দুটির মারাঠি ভাষায় অনুবাদ করেন বিষ্ণু পরশুরাম শাস্ত্রী। অনেক লড়াই করার পর  ১৮৫৬ সালে ২৬ জুলাই ১৫ নম্বর রেগুলেশন দ্বারা বিধবা বিবাহ প্রবর্তন করেন লর্ড ডালহৌসি।

হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফাণ্ড সুষ্ঠ ভাবে পরিচালনার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। একশ শতাংশ ‘এফোর্ড’ দিয়েছিলেন এই ফাণ্ডের জন্য। এই ফাণ্ড প্রথম শুরু হয়েছিল ৩২ নম্বর কলেজস্ট্রিট অঞ্চলে। ১০ জন সদস্যকে নিয়ে এই ফাণ্ড পথ চলা শুরু করে। এছাড়া অনেকে দান করেন। প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন শ্যামাচরণ দে আর সহ চেয়ারম্যান ছিলেন মুরলীধর সেন। সদস্যদের স্বাস্থ্য আধিকারিক ছিলেন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। আর ডিরেক্টর ছিলেন রায় বাহাদুর দীনবন্ধু মিত্র, ঈষাণ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়,  নন্দলাল মিত্র, রাজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গোবিন্দচন্দ্র ধর সহ মোট ১০ জন। আর এই ডিরেক্টরদের সঙ্গেই ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিরোধ শুরু হয়। ১৮৭৬ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি ট্রাষ্টি থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি ২০ পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখলেন। কারনগুলো লিখলেন। চিঠিটি ছিল বাংলা ভাষায়।

‘অতএব অল্প বয়সে যে বৈধব্য দশা উপস্থিত হয়, বাল্য বিবাহই তাহার মুখ্য কারণ। সুতরাং বাল্য কালে বিবাহ দেওয়া অতিশয় নির্দয় নৃশংসের কর্ম। অতএব আমরা বিনয় বচনে স্বদেশীয় ভদ্র মহাশয় দিগের সন্নিধানে নিবেদন করিতেছি, যাহাহে এই বাল্য পরিণয় রূপ দুর্নয় অস্মদেশ হইতে অপনীত হয়। সকলে একমত হইয়া সতত এমত যত্নবান হউন।’এই লিখে তিনি শেষ করলেন বাল্য বিবাহের দোষ প্রবন্ধটি।

বিধবা বিবাহ নিয়ে লড়াই করে বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন আর হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফাণ্ড প্রতিষ্ঠা করা ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অন্যতম সমাজ কল্যাণমূলক কাজ হিসেবে চিরস্মরণীয় রয়ে গেছে।

error: Content is protected !!

Discover more from Sambad Pratikhan

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading