বাতাস লাগুক প্রাণে

ভারতবর্ষের মত গ্রীষ্ম প্রধান দেশের লোকেরা বৈদ্যুতিক পাখা আসার আগের যুগে কিভাবে সহ্য করত প্রখর তাপের দাবদাহ ? সেই নিয়ে লিখলেন পারমিতা চক্রবর্তী ভট্টাচার্য্য

ফিরে তাকালে বেশিদিন নয় , টাইম মেশিনে চড়ে  এই মাত্র ২০০ বছর আগে পিছিয়ে গেলেই দেখব আজকের দিনের এয়ার কন্ডিশনার দুরস্থ , তখন ইলেকট্রিক পাখাও ব্যবহার হয়নি।

আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রাকৃতিক এয়ার কন্ডিশনার ছিল তাই বৃক্ষ ছায়া,  বাড়ির উঠোন। আর বিশ্রাম কালে গরম আরো সুতীব্র হলে আরো আগে থাকতেই মানুষ শিখেছে হাত পাখার ব্যবহার। ইতিহাস বলে পাখার ব্যবহার নাকি আজ থেকে খ্রীষ্ট পূর্ব ৫০০ বছর আগে মানুষ শিখেছিল। শোনা যায় যে মধ্য এশীয় দেশ এবং আফ্রিকাতে হাত পাখার ব্যবহার ছিলই,  এটা মেনে নেওয়া ভুলও হবেনা কারন ভৌগলিক ভাবে এই জায়গা গুলো পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চাইতে অপেক্ষাকৃত উষ্ণই ছিল, তাই স্বস্তির নিরিখে মানুষের পক্ষে তালপাতা বা ওই জাতীয় পাতা দিয়ে তৈরি হাত পাখা ব্যবহার খুব স্বাভাবিক । পুরনো অনেক তৈলচিত্র বা লেখাতে আমরা হাতপাখার ব্যবহারের নিদর্শন আমরা পাই। সাধারণ মানুষ নিজেই হাতপাখার হাওয়া দিয়ে নিজেকে তৃপ্ত করত কিন্তু উচ্চ বিত্তদের ক্ষেত্রে এমন কেন হবে! তাদের জন্য পরিশ্রম করে পাখার বাতাসের আয়োজন করবে অন্য কেউ।

তাই বিদ্যুতের আগমনের আগের সময়ে হাত পাখা ব্যবহারের দিনগুলোতে চোখ রাখলে এক হারিয়ে যাওয়া পেশার বা জীবিকার কথা সামনে আসে।ওরা ছিল পাঙ্খাওয়ালা।  অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শ্রেণীর মানুষরা তখন কারো বাড়ি, সভা, দপ্তরে অবিরাম ভাবে পাখা নাড়িয়ে বাতাস দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আর উচ্চবিত্তরা গরমের প্রকোপ থেকে আরাম পেতে নিয়োগ করতেন সেই পাঙ্খাওয়ালাদের। আজকের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে যে কথা ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে।

আমাদের পুরনো রাজারাজরাদের দুপাশে দুজন আজ্ঞাবহ, অবিরাম পাখার হাওয়া পরিবেশন করে যাচ্ছে, এমন দৃশ্য আমাদের খুবই পরিচিত। কখনো সেই পাখা হত বিশাল বড় ও ভারী দাঁড় যুক্ত, এতটাই বড়সড় যে তাকে মাটিতে কাত করে রেখে পাঙ্খাওয়ালারা সেটিকে নাড়িয়ে যেত। পাখার ছড়ানো অংশে থাকত নকশা করা মলমল বা সিল্কের কাপড়, যার চলাচলে গরমকালের গুমোট হওয়া সরে গিয়ে আরাম লাগত।

কিন্তু এভাবে তো খুব বেশি হাওয়া পাওয়া সম্ভব না! তাই প্রয়োজনের তাগিদেই পাঙ্খাওয়ালাদের হাতে হাতপাখার বদলে উঠে এল হাতেটানা পাখা। হাতে টানা পাখা মানে, আগের হাতপাখার চাইতে আর একটু বেশী হাওয়া, আর একটু বেশী পরিসর জুড়ে। সেকেলের বড়ো বড়ো ঘরে ছাতের উচ্চতা ছিল যথেষ্ট বেশী। ছাত থেকে ঝোলানো টানা পাখা গুলো ছিল বিশালাকার।  ১০ ফুট থেকে শুরু করে ২০-৩০ ফুটও হত কখনো কোনো বড়ো হল রুম বা সভা গৃহের ক্ষেত্রে। হালকা ধরনের কোনো কাঠ দিয়ে তৈরী হত এর কাঠামো, যা মোড়া থাকত কাপড়, কাগজ দিয়ে। আর তার নিচের অংশে থাকত মসলিনের ঝালোড়।

এই পুরো পাখা টি ঘরের ছাত থেকে ঝুলত কিছু আঁকশী ও তার থেকে ঝুলন্ত বাহারি দড়ি দিয়ে। এবার পাখাটি টানার পালা, তাই এলো পাঙ্খাওয়ালা। বলে রাখা ভালো যে এই টানা পাখার গা থেকেই বেশ একটি শক্ত দড়ি বের করে রাখা হত, যা ঘরের দুটি বিপরীত দেওয়ালের সঙ্গে আটকানো দুটি পেতলের চাকার ওপর দিয়ে ঘুরে আসত, ঠিক যেমন ভাবে আগেকারদিনে পাত কুয়োতে কপিকল দিয়ে দড়ি টেনে জল তোলা হত কম পরিশ্রমে। যাই হোক শেষ অবধি এই দড়ির সব শেষ প্রান্তটি আবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসত একেবারে বাইরে,  কিছু ক্ষেত্রে দেওয়াল ফুটো করেও এটাকে বাইরে আনা হত। সুতরাং পাঙ্খাওয়ালা থাকবে ঘরের বাইরে,  ঘরের গোপনীয়তা রক্ষার কথা ভেবেই যে এমন আয়োজন তা বলাই বাহুল্য।

ঘরের মানুষদের আলোচিত কথা যেন পঙ্খাওয়ালাদের মারফত বাইরে না যায় সেজন্য এই কার্যে বধির পঙ্খাওয়ালাদেরই চাহিদা ছিল বেশি। দিনরাত একভাবে ঘরের বাইরে বসে বসে টানাপাখার দড়িতে টান দিতে দিতে তারা জীবনের বেশি সময় কাটিয়ে দিত,  পেত নাম মাত্র পারিশ্রমিক,  কখনো কখনো তাদের দিয়ে ফাই ফরমাশ ও খাটিয়ে নিত মালিক। ঘরের মধ্যে আর ঘরের বাইরে তখন এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। ঘরের মধ্যে টানা পাখার শীতল হাওয়ার মাঝে সুখনিদ্রা তে গৃহস্বামী আর ঘরের বাইরের অন্ধকারে মশার কামড় সহ্য করে ঘুম ঘুম চোখে সদা জাগ্রত পঙ্খাওয়ালা।  তাদের এক দন্ডও ঘুমোলে চলবেনা,  তাদের ঘুমে যে ঘুম ভেঙে যাবে গৃহস্বামীর। তাই তারা একটা নির্দিষ্ট ছন্দে পাখার দড়ি টেনে যেত নিরলস ভাবে।

কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে টানা পাখা আর তার সাথে হারিয়ে গেছে আরও কিছু কথা যা ছিল শুধু এই পাখা সম্বন্ধীয়। এরকমই দুটি কথা হল বেঙ্গল সাইড আর বোম্বে সাইড। আজ আমরা জানিনা কিভাবে এই শব্দ খণ্ড দুটি টানা পাখার সাথে জড়িত। যদিও শুনলে ব্যাপারটি বেশ যুক্তিপূর্ণই লাগবে।

টানা পাখা চললেও কিন্তু কোনো ঘরের সর্বত্র এক ভাবে হাওয়া খেলত না, দড়ি টানলে পাখাটি সামনে এগিয়ে যেত  আর দড়ি ছাড়লে আবার পশ্চাৎ পশরণ করে আবার ফিরে আসত নিজের জায়গাতে। ঘরের যেদিকে পাখা এগিয়ে যেত, স্বভাবতই সেদিকটায় ভালো হাওয়া লাগত, আর যেদিকে পাখা টি পিছিয়ে আসত সেদিকে অপেক্ষাকৃত কম হাওয়া খেলত। তাই বেশি হাওয়ার দিকটা বা পাখা এগিয়ে যাওয়ার দিক টাকে বলা হত বোম্বে সাইড আর উল্টোদিকটা বেঙ্গল সাইড। এই নামকরণ হয়েছিল পুরোপুরি মৌসুমী বায়ুর গতিপ্রকৃতির ধরনের রীতিমত। জলকণা সমৃদ্ধ দ: প: মৌসুমী বায়ু প্রথমে আসে ভারতের পশ্চিম উপকূলে, বোম্বের দিকে তার জোরালো প্রভাব নিয়ে, প্রবল গতিতে। তাই টানা পাখার বেশি হাওয়ার দিকটাকে বলা হত বোম্বে সাইড। অন্য দিকে সেই মৌসুমী বায়ু ভারতের পূর্ব উপকূলে বা বাংলায় আসতে আসতে তার গতিবেগ বহুলাংশে কমে যায়, তার কম হাওয়া আর অপেক্ষাকৃত কম প্রভাব হয় সেখানে , তাই টানা পাখার কম হাওয়া দিকটা হল বেঙ্গল সাইড।

বড় বড় হল ঘরের ক্ষেত্রে এরকম টানা পাখা একাধিক থাকত, যেগুলো সবগুলো আদপে একসাথে একটি অন্তিম দড়ির সাথে সংযুক্ত থাকত, যা সাধারণত ঘরের বাইরে বেরিয়ে ধরা থাকত পাঙ্খাওয়ালার হাতে। খুব কম বেতনে সমাজের নিচুতলার দরিদ্র কিছু মানুষদের পাঙ্খাওয়ালা হিসেবে নিয়োগ করা হত, অত্যন্ত কম বেতনে, কখনো তার সাথে ওই একই মাইনেতে কিছু ফয়ফরমাসও খাটিয়ে নেওয়া হত।

আমাদের দেশে বিদ্যুৎ এসেছে সম্ভবত ১৮৭৯ সালে, আর তার প্রায় আরো বিশ বছর পর মানে ১৮৯৯ নাগাদ ইলেকট্রিক পাখা আসে।লোকদের গরম থেকে মুক্তি দিয়ে পাখার বাতাস দিয়ে যারা আরাম দিয়ে এসেছে তারা হঠাৎই কর্মহীন হয়ে পড়ল এদেশে বিদ্যুৎ আসার পর থেকে। বৈদ্যুতিন পাখার হাওয়া সবার জীবনে আনন্দ নিয়ে এলেও পাংখাওয়ালাদের জীবনে এনেছিল বেকারত্বের ইঙ্গিত। তাই সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গেল অতীতের পাঙ্খাওয়ালারা চিরকালের জন্য।

তথ্য ও ছবি সূত্র : দামু মুখোপাধ্যায়ের “টানা পাঙ্খার গল্প” ও গুগল 
%d bloggers like this: