পিরিয়ড চলাকালীন নানান উপসর্গ থেকে রেহাই পেতে কি করবেন

মহিলাদের পিরিয়ড চলাকালীন নানান উপসর্গ দেখা দেয়, এর হাত থেকে রেহাই পেতে কি করনীয় ও কোন কোন খাবার খাওয়া উচিত? সে সম্পর্কে আলোকপাত করছেন আত্রেয়ী দো

পিরিয়ড চলাকালীন নানান উপসর্গগুলির হাত থেকে রেহাই পেতে খাদ্যতালিকায় রাখুন এই খাবারগুলি। পিরিয়ড বা রজ:স্রাব চলাকালীন অপরিচ্ছন্ন এবং অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের কারণে আমাদের দেশে বহু মহিলাই প্রস্রাব সংক্রমণ এবং জরায়ু মুখের ক্যান্সার জনিত অসুখে আক্রান্ত হন। রজস্রাব বা পিরিয়ড প্রত্যেক মহিলার জীবনেই একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। জননগত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রজ:চক্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

একজন নারীর নিয়মিত এবং সঠিকভাবে ঋতুমতী হওয়ার অর্থ তিনি সন্তান ধারণে সক্ষম।রজ:স্রাব বিষয়টি অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া,কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। পিরিয়ড বিষয়টি আজও আমাদের দেশে একটি লজ্জাজনক বিষয়। সে কারণেই মহিলারা পিরিয়ড সংক্রান্ত সমস্যাগুলি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে কুন্ঠাবোধ করেন। এই রাখঢাক এবং অসচেতনতার কারণে তারা পরবর্তীকালে নানান ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হন।  মহিলাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকটি মাথায় রেখে পিরিয়ড চলাকালীন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যবিধি এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা অত্যন্ত জরুরী। এই সম্পর্কে সাধারণ সাধারণ মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে ২৮ শে মে দিনটি বিশ্বব্যাপী ‘রজ:স্রাব স্বাস্থ্যবিধি দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।

আগে জেনে নিই এই রজ:চক্র আসলে কি?  

মহিলাদের পিউবার্টি দশার শুরু থেকে মেনোপজ পর্যন্ত প্রতি মাসে গর্ভাবস্থা ব্যাতীত  সময়কালে জরায়ু থেকে গৌণ উসাইট সহ যে রক্তক্ষরণ হয়,তাকে রজ:চক্র বা ঋতুচক্র বলে।

নারীদের যৌন জীবনে ২৮ দিন অন্তর অন্তর ভগ্ন ও বিচ্ছিন্ন জরায়ু গাত্র, অনিষিক্ত ডিম্বাণু, লিউকোসাইট কোশ ও মিউকাস মিশ্রিত রক্ত যোনিপথে বের হয়। একেই রজ:স্রাব বলে। এর স্থায়িত্ব ৩-৪ দিন।

পিটুইটারি গ্রন্থি নি:সৃত গোনাডো ট্রফিন হরমোনের প্রভাবে ৮-১৩ বছরের কিশোরীদের প্রথম রজ:স্রাব শুরু হয়। এই সূচনা কালকেই পিউবার্টি বলে। ৪০-৫০ বছর বয়সের মহিলাদের রজঃস্রাব সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায় এই সমাপ্তি কালকেই মেনোপজ বলে।

সঠিক খাদ্যাভাস ও সুস্বাস্থ্য পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। খাদ্য তালিকায় সামান্য কিছু পরিবর্তন আনলে পিরিয়ড বা রজস্রাব চলাকালীন সমস্যা গুলি থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে। যেমন – রজস্রাব চলাকালীন শরীর থেকে বেশ কিছুটা পরিমাণ রক্ত বেরিয়ে যায়। তাই এই সময় আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। এছাড়াও ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক ইত্যাদি উপাদানগুলি পিরিয়ডের লক্ষণগুলির উপশমে সাহায্য করে তাই এই উপাদানগুলিকেও খাদ্যতালিকায় রাখা প্রয়োজন।

এই সময় খাদ্য তালিকায় রাখুন এই খাবারগুলি

* সবুজ শাকসবজি যেমন পালং শাক,ব্রকোলি,ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে যা পিরিয়ডের ব্যথা উপশমে সাহায্য করে।

* হলুদ একটি দুর্দান্ত প্রদাহ নিরাময়কারী মশলা। এটি পিরিয়ডের ক্র্যাম্প এবং অন্যান্য লক্ষণগুলির উপশমে ভূমিকা নেয়।

* মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ আয়রন, প্রোটিন এবং ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড। এই উপাদানগুলি পিরিয়ড চলাকালীন ব্যথার উপশমে সাহায্য করে। ওমেগা-3-ফ্যাটি অ্যাসিড মেনস্ট্রুয়াল ডিপ্রেশন বা পিরিয়ড চলাকালীন অবসাদ দূরীকরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই এই সময় প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায় রাখুন মাছ বিশেষত সামুদ্রিক মাছ যেমন – সালমন, সার্ডিন,টুনা, ওয়িস্টার্স ইত্যাদি।

* শরীরে জলের অভাবে ডিহাইড্রেশন হলে পিরিয়ড চলাকালীন উপসর্গগুলি যেমন, পেটে ব্যথা, মাথা ব্যথা ইত্যাদি বেড়ে যেতে পারে। তাই এই সময় প্রচুর পরিমাণে জল পান করুন আর পাশাপাশি খাদ্য তালিকায় রাখুন জল জাতীয় বিভিন্ন খাবার যেমন –  তরমুজ, শশা ইত্যাদি।

* দই একটি প্রবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার যা শরীরকে পুষ্টি জোগায়। পিরিয়ড চলাকালীন যোনিতে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমনের আশঙ্কা থাকে। দই এই ধরনের সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়।

* ডিম একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় সুপারফুড। ডিমের পুষ্টিগুণ পিরিয়ড চলাকালীন ব্যথা উপশমে সহায়তা করে এবং শরীরে পুষ্টি বজায় রাখে।

* মুসুর ডাল প্রোটিন এবং আয়রনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস, বিশেষত নিরামিশাষীদের কাছে। তাই এই সময় খাদ্য তালিকায় রাখুন মুসুর ডাল।

* বিট জাতীয় শস্যে থাকে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান যেমন – আয়রন,প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম,ওমেগা-3-ফ্যাটি অ্যাসিড ইত্যাদি।এই উপাদানগুলি পিরিয়ডের উপসর্গগুলির উপশম করে। বীজ জাতীয় শস্যগুলি কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণেও সাহায্য করে।

* চিনা বাদাম,আখরোট ইত্যাদিতে প্রোটিন, ম্যাগনেসিয়াম,ওমেগা -3- ফ্যাটি অ্যাসিড ইত্যাদি উপাদান সমৃদ্ধ থাকে। এই উপাদান গুলি পিরিয়ডের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।

* আদার বিভিন্ন উপকারী গুণের জন্য এটিকে একটি সুপারফুড হিসেবে গণ্য করা হয়। পিরিয়ড চলাকালীন বমি-বমি ভাব অনুভব হলে, আদা খেতে পারেন। আদা এই ধরনের উপসর্গের উপশমে দারুণভাবে কার্যকরী।

* তোফুতে রয়েছে প্রোটিন,আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি নানান পুষ্টি উপাদান। তাই এই সময়ে তোফু রাখুন খাদ্য তালিকায়।

* অন্যান্য গোটা শস্যের মত কুইনোয়া বা কাউন চালও প্রোটিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এতে রয়েছে ফাইবার ছাড়াও আরো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। এই উপাদানটি হজমেও সাহায্য করে।

* ডার্ক চকোলেটও একটি অন্যতম সুপারফুড হিসেবে বিবেচিত হয়। এতে রয়েছে আয়রন এবং ম্যাগনেশিয়াম। দুটি উপাদানই পিরিয়ডের ব্যথা উপশমে সাহায্য করে। এছাড়া ডার্ক চকোলেট ‘অ্যান্টি ডিপ্রেশন’ হিসেবে কাজ করে। তাই পিরিয়ড চলাকালীন মানসিক অবসাদ থেকে রেহাই পেতে বেছে নিন ডার্ক চকলেট।

সঠিক খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। হালকা শরীরচর্চা শরীরের জন্য উপকারী এবং পিরিয়ডের ব্যাথাতেও উপশম দেয়।

পিরিয়ড চলাকালীন পিরিয়ড সংক্রান্ত সমস্যাগুলি থেকে মুক্তি পেতে এই খাবারগুলি এড়িয়ে চলুন –

* প্রসেসড ফুড, ফাস্টফুড।

* উচ্চ শর্করা যুক্ত খাবার।

* ময়দা থেকে তৈরি খাবার বিশেষত বেকড প্রোডাক্ট, যেমন – পাউরুটি,পাস্তা ইত্যাদি।

* দেরিতে হজম হয় ফলে গ্যাস হতে পারে এমন খাবারগুলি এইসময় এড়িয়ে চলুন।

* ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষায় জানা গেছে অধিক মাত্রায় সোডিয়াম গ্রহণে শরীর ফুলে যায় ফলে দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পায়। তাই অধিক মাত্রায় সোডিয়াম গ্রহণ এড়িয়ে চলুন। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন এর একটি তথ্য থেকে জানা যায়, প্রাত্যহিক ১৫০০ মিলিগ্রামের বেশি সোডিয়াম গ্রহণ করা উচিত নয়।

পিরিয়ড নিয়ে রয়েছে নানান কুসংস্কার, খাবারেও রয়েছে অনেক বিধি-নিষেধ। এইসব সমস্ত কুসংস্কারের বেড়াজাল ভেঙে এগিয়ে আসতে না পারলে অনেক বড় মাসুল গুণতে হতে পারে।

error: Content is protected !!

Discover more from Sambad Pratikhan

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading