দ্রুত নগরায়নে বড় গাছের সংখ্যা কমছে, সংকটে পেঁচারা

বিশেষ প্রতিবেদন, অভিজিৎ হাজরা : কৃষি জমির পাশেই পেঁচার জন্য বাসা বানিয়ে রাখেন পশ্চিম এশিয়ার কয়েকটি দেশের কৃষকেরা। এর কারণ হিসাবে জানা যায়  পেঁচারা জমির ধারে থাকা ইঁদুর খেয়ে ফসলকে রক্ষা করে থাকে। জর্ডন, ইজরায়েল, প্যালেসস্টাইনের মতো দেশের কৃষকেরা এই পদ্ধতি অবলম্বন করে বাস্তুতন্ত্রে পেঁচাদের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। অথচ এই পেঁচাকে ঘিরে নানান কুসংস্কারের অন্ত নেই আমাদের দেশে। একদিকে দিনের পর দিন গাছের সংখ্যা কমছে, তার উপর কুসংস্কার, এই দুই সাঁড়াশি আক্রমণে পেঁচার সংখ্যা ক্রমশই কমছে। যা নিয়ে বিশেষ উদ্বিগ্ন পরিবেশ কর্মী থেকে পরিবেশ প্রেমী ও বনদপ্তর। এই বিষয়ে সকলকে সচেতন হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন সকলেই। মূলত বড় গাছের কোঠর, পরিত্যক্ত বাড়ি,চিলে কোঠা, অপেক্ষাকৃত অন্ধকার ঘর পেঁচাদের বসবাসের ঠিকানা।এক প্রকার বিপন্ন হতে বসেছে লোক চক্ষুর অন্তরালে থাকা এই নিশাচর প্রাণী। অপরদিকে যথেচ্ছভাবে বড় গাছ সরকারি, বেসরকারি ভাবে কাটা হচ্ছে।

চোরাকারবারিরাও রাতের অন্ধকারে গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে গাছ পড়ে যাচ্ছে। ফলে গাছের কোঠরের সংখ্যাও কমছে। হাওড়া জেলা যৌথ পরিবেশ মঞ্চের সদস্য-সদস্যাদের অভিমত – দ্রুত নগরায়ন এর ফলে নির্বিচারে বড় গাছ থেকে ছোট গাছ কাটা হচ্ছে। এছাড়া আয়লা, আমফানের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বহু গাছ উপড়ে গিয়েছিল হাওড়ার বিভিন্ন এলাকায়। অপরদিকে আবার বাড়িতে পেঁচা ঢুকলে কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিগত কয়েক মাস আগে গ্রামীণ হাওড়া জেলার আমতা ২ নং ব্লকের অন্তর্গত নারিট গ্রামের একটি বাড়ির চিলে কোঠায় একটি লক্ষী পেঁচা তার বাচ্চাদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। বাড়ির লোকের নজরে আসায় তারা পেঁচার বাচ্চাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পাশের একটি বাঁশ বাগানে রেখে আসে। এই একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে আমতা ১ নং ব্লকের খড়দহ গ্রামে। সেখানে চিলেকোঠায় আশ্রয় নেওয়া পেঁচা ও তার বাচ্চাদের রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

এছাড়াও চিনা মাঞ্জা সূতো পেঁচাদের প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। কিছুদিন আগেই বাগনানের শীতলাপুরে একটি পুকুরের উপর টাঙানো জালে জড়িয়ে গিয়েছিল একটি লক্ষী পেঁচা। হাওড়ার জগৎবল্লভপুরের মাজুতে গাছে জড়িয়ে থাকা চিনা মাঞ্জা সূতায় জড়িয়ে যায় একটি পেঁচা। এই রকম অজস্র ঘটনার সাক্ষী হাওড়া জেলার বিভিন্ন গ্রাম, পরিবেশ প্রেমী, পরিবেশ কর্মী থেকে বন দপ্তর। বিগত বছরেই হাওড়ার বিভিন্ন এলাকায় চিনা মাঞ্জা সূতায় ৪০ থেকে ৫০ টি পেঁচা আটকে পড়েছিল। এই বছরে এখনও পর্যন্ত হাওড়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় ১০ থেকে ১৫ টি পেঁচা আটকে পড়েছে বলে জানান হাওড়া জেলা যৌথ পরিবেশ মঞ্চের সদস্য-সদস্যারা। বাগনানের পরিবেশ কর্মী চিত্রক প্রামাণিক বিগত বছরেই শুধু বাগনান ও আশপাশ এলাকা থেকে ১০ টি আহত পেঁচাকে উদ্ধার করে বন দফতরের কর্মীদের হাতে তুলে দিয়েছেন, নতুবা প্রাকৃতিক পরিবেশে ছেড়ে দিয়েছেন। পেঁচাদের রক্ষার জন্য শুরু হয়েছে এলাকায় এলাকায় সচেতনতার প্রচার। তবে তাতে করে যে খুব একটা কাজ হচ্ছে তা দাবি করা যাবে না।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষক ইন্দ্রজিৎ আদক এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘হাওড়া জেলায় এখনও পর্যন্ত সাতটি প্রজাতির পেঁচার দেখা মিলেছে। যার মধ্যে রয়েছে ব্রাউন ফিস আউল, উরাসিয়ান বার্ণ আউল, কোলরেড স্কুপ আউল, স্পটেড আউল, ওরিয়েন্টাল স্কুপ আউল ইত্যাদি রয়েছে। এদের রক্ষা করাটা আমাদের অবশ্যই দরকার।’ পেঁচার এই বিপন্নতার কথা এক বাক্যে স্বীকার করে বন দফতরের হাওড়া আরবান রেঞ্জের আধিকারিক নির্মল মন্ডল বলেন, ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে দ্রুত নগরায়ন ঘটছে। বড় গাছের সংখ্যাও দিনের পর দিন কমছে। পেঁচারা সাধারণ বড় গাছের কোঠরে থাকতে ভালোবাসে। গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে দেখা যাচ্ছে একই গাছে যেমন পেঁচা বাসা বাঁধছে তেমনই অন্য পাখি ও বাসা বাঁধছে। সেক্ষেত্রে নিভৃতে থাকতে চাওয়া পেঁচা তার সহজাত পরিবেশ হারিয়ে ফেলছে। পেঁচাদের রক্ষা করার জন্য সচেতন নাগরিক, পরিবেশ প্রেমী, পরিবেশ কর্মী,বন দফতরের পাশাপাশি সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে।’

error: Content is protected !!

Discover more from Sambad Pratikhan

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading