নীলাচলের অন্দরে

কিশলয় মুখোপাধ্যায়: পুরী, বাঙালির অতিপ্রিয় তীর্থস্থান আর সমুদ্র স্নান তথা ভ্রমণের জায়গা। জগন্নাথ দেবের মন্দির হল এক পবিত্র স্থান যেখানে দলে দলে ভক্তরা আসে তাদের আরাধ্য দেবতাকে দর্শন করতে। আমরা কজন ২৮ এপ্রিল ২০২৩ পুরী জগন্নাথ দেবের মন্দির প্রাঙ্গনে সকাল ১০:৩০ নাগাদ পৌঁছালাম। আমাদের পাণ্ডা ছিলেন চন্দ্রশেখর খুন্তিয়া। কথায় কথায় তিনি বললেন আপনারা ভালো দিনেই এসেছেন। আজকের দিনে বলা যায় জগন্নাথ দেব, বলভদ্র আর সুভদ্রার রত্ন সিংহাসনে অভিষেক হয়েছিল। অর্থাৎ বলা যায় এই দিন থেকেই প্রভুকে ভক্তরা দর্শন করা শুরু করে। আজ শ্রীজগন্নাথদেব হলেন বিশ্বের মহপ্রভু। এই উৎসবকে বলা হয় নীলাদ্রি মহদয়। অনেকে জগন্নাথের জন্ম নক্ষত্র দিবসও বলে। আমরা জানতাম না। চন্দন উৎসবটি জানতাম। সত্যি কথা বলতে কি এ হল প্রভুর অমোঘ লীলা। জয় জগন্নাথ।

দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার, সময়টা দ্বিতীয় প্রহর। প্রভু জগন্নাথদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রার দারু মুর্তি  রত্নসিংহাসনে প্রতিস্থাপন করেন স্বয়ং ব্রহ্মা।অভিষেকের সময় উপস্থিত ছিলেন ব্রহ্মা, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। রাজা ব্রহ্মাকে নিমন্ত্রন করেছিলেন। এছাড়া নারদমুনি, ঋষি ভদ্বজা, বিশ্ববসু ও আরো কয়েকজন ঋষিগণ উপস্থিত ছিলেন। এই দিনটাকে স্মরণ করেই এই নীলাদ্রি মহদোয় অষ্টমী উৎসব হয়। একে ত্রয়োদশ যাত্রাও বলা হয়।

কলিযুগের শুরুতে অধুনা ওড়িশার এক সমুদ্রতীরে শ্রী বিষ্ণু নীলমাধব রূপে আবিভূর্ত হলেন। শবর জাতির বিশ্ববসু একদিন ঘন জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে নীলমাধবের দেখা পেলেন। তিনি নীল মাধবকে পুজো করতে লাগলেন। অবন্তীরাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন এই নীলমাধবের কথা জানতে পেরে রাজপুরহিতের ভাই বিদ্যাপতিকে পাঠালেন এই সম্পর্কে খোঁজখবর করতে। বিদ্যাপতি শ্রীক্ষেত্রে এসে নীলমাধবের দেখা পেয়েছিলেন। কিন্তু রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন এখানে এসে দেখতে পেলেননা। এই সময় শ্রীবিষ্ণু স্বপ্নাদেশে রাজাকে বললেন নীলমাধবের পরিবর্তে আমার দারুমুর্তি দেখতে পাবে। আর সেই মুর্তি পুজো করবে ও কলিকালে ভক্তদের দর্শন দেব। এই ভাবে কলিকালে জগন্নাথদেব পুরীতে আবির্ভাব হলেন। আর এই দিন বা তিথিতে হয় নীলাদ্রি মহোদয় উৎসব। বৈশাখ মাসের শুক্লাপক্ষের অষ্টমীর দিন এই উৎসব পালন করা হয়। এই বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে দিনটি ছিল ২৮ এপ্রিল। ১০৮টি পটে জল নিবেদন করা হয়। একে ‘জলবিজে’বলা হয়। দপর্ণ স্নানের পর কিছু বিশেষ পুজো করা হয় যাকে বলা হয় ‘অভিষেক’। ওই পবিত্র জলে থাকে কর্পূর, সুগন্ধী ফুল, আমলা। এছাড়া চন্দন বাটার প্রলেপ থাকে।  যে সেবকরা জল বয়ে নিয়ে যায় তাদেরকে বলে গরবাদু (Garabadu)। মন্দিরের সমস্ত পুজোপার্বণের জল এই সেবকরা বয়ে নিয়ে যায়। এরপর চন্দন যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হয়।

জগন্নাদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রা দর্শন করার আগে ২২টি সিঁড়ি পেরোতে হয়। একে বাইশি পাহাচ বলে। এ অতি পবিত্র স্থান। প্রথম ৫টি সিঁড়ি হল চোখ, কান, নাক, জিভ আর ত্বক। অর্থাৎ ৫টি ইন্দ্রিয়ের প্রতীক। এরপর ৫টি সিঁড়ি প্রাণের প্রতীক। তারপরের ৫টি সিঁড়ি হল রপ, রস,গন্ধ,শব্দ,স্পর্শ এগুলোকে বোঝায়। এরপর ৫টি সিঁড়ি ক্ষিতি,অপ, তেজ, মরুৎ আর ব্যোম অর্থাৎ পঞ্চভূতের প্রতীক। এরপর ২টি সিঁড়ি হল মানুষের বুদ্ধি ও অহংকার। আর জৈনরা বলেন এই ২২টি হল ২২জন তীর্থংকর। এঁদের পূন্য স্পর্শ নিয়ে তারপর দেব দর্শন। জগন্নাথদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রা দর্শন করে এবং মন্দির দর্শনের মাঝে একজায়গা বসে চন্দ্রশেখর বাবুর কাছে শুনছিলাম এই সব সুন্দর পৌরানিক কাহিনী। অনেক ভক্তগন বিশ্বাস করেন যে প্রভু বিষ্ণু বদ্রিনাথ ধামে অর্থাৎ অলকানন্দা নদীতে স্নান করেন। তারপর দ্বারকা ধামে পোষাক পরেন। এরপর পুরী ধামে আহার করেন। এরপর  রামেশ্বরম ধামে বিশ্রাম করেন। তাই বিষ্ণুর চার ধামের মধ্যে পুরীধামের পরিচিতি পঞ্চব্যঞ্জনের জন্য। এই প্রসাদকে বলা হয় মহাপ্রসাদ। এই মন্দিরে সতীর ৫১ পিঠের মধ্যে একটি পিঠ রয়েছে যা দেবী বিমলা রূপে পূজিত হন। মহাপ্রভুকে ভোগ দেবার পর বিমলা দেবীকে সেই ভোগ নিবেদন করার পরই মহাপ্রসাদ হয়। এই প্রসাদ স্পর্শ দোষে কখনও অপবিত্র হয়না, কখনও এঁটো হয়না। একই পাত্র থেকে একসঙ্গে গ্রহণ করা যায়। এখানে নিম্ন বর্ণের ভক্তকূল মন্দিরে বসে প্রসাদ খায়। সত্যি কথা বলতে কি প্রভুর এই স্থান এই প্রসাদ সবার। মহাপ্রভু স্বপ্নাদেশে রাজাকে আদেশ করেছিলেন যে সেবক বিশ্ববসু আমাকে নীল মাধব রূপে সেবা করেছে তাই তার বংশধরেরা মন্দিরে দয়িতাপতি নামে আমার সেবা করবে। দয়িতাপতি হল দৈত্য বা শবর সম্প্রদায়ের দলপতি। বিদ্যাপতির ব্রাহ্মন স্ত্রীর বংশধরেরা পূজা পাণ্ডা নামে পরিচিত হয়ে আমার পূজা করবে। বিদ্যাপতি ও ললিতা শবরের বংশধরেরা সূপকার নামে পরিচিত হয়ে আমার ভোগ রান্নার কাজে নিয়জিত থাকবে।

এবার আমাদের ফেরার পালা। এই পৌরানিক কাহিনী কম বেশি সবারই জানা। সবচেয় তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল জাতপাতের কোন বিচার নেই মহাপ্রভুর কাছে। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলেন ক্ষত্রিয়, শবর দলপতি ছিলেন বিশ্ববসু, বিদ্যাপতি ছিলেন ব্রাহ্মণ। ললিতা দেবী ছিলেন শবর সম্প্রদায়। মন্দিরের উঠোনে দাঁড়িয়ে মন্দিরের চূড়ায় পতাকাকে প্রণাম করে যখন  বাইরে বড়িয়ে এলাম তখন বিশ্বাস করুন সবার মনটা ভালো হয়ে গেল। মহাপ্রভুর অশেষ করুণায়  আমরা দুটো বড় উৎসবের সাক্ষী হয়ে রইলাম। নীলাদ্রি মহোদয় অষ্টমী আর চন্দন যাত্রা। জয় জগন্নাথ।

error: Content is protected !!

Discover more from Sambad Pratikhan

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading