কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা বেনারস, ৭২৫ কিলোমিটার পথের এবং তাঁদের ভ্রমণের বিস্তারিত নিয়ে কলম ধরলেন মিমি গুহ
প্রথম পর্ব
প্রতি বারের মতো এবার ও আগে থেকে প্ল্যান ছিল না বেনারাস যাওয়ার। হঠাত্ দু’দিন ছুটি পেলাম আর বাকিটা ম্যানেজ করে বেরিয়ে পড়লাম কাশী বেনারাস এর উদ্দেশ্যে। ঘড়িতে তখন ভোর ৪:৫৭ আমরা পাড়ি দিতে চলেছি ৭২৫ কিমি রাস্তা। কলকাতা শহরে তখন ভোর হচ্ছে। রাস্তা সব ফাঁকা। আমাদের গাড়ি ছুটে চললো। দক্ষিনেশ্বর এর কাছে এসে প্রথম টোল। এরপর সিঙ্গুরের ভিতর দিয়ে বেলু মিল্কী রোড ধরে এসে পৌঁছালাম এন.এইচ ১৯এ। এবার দ্বিতীয় টোল পেরিয়ে শক্তিগড় যখন পৌঁছাই ঘড়িতে তখন সকাল ৭.০৬। কচুরি, মিষ্টি, দই বোঝাই করে আবার এগিয়ে চললাম। মোটামুটি সকাল ৭:৪০এ বর্ধমান আর সকাল ৮:২৪ পানাগড় পৌঁছে গেলাম। রাস্তায় পণ্যবাহী যানবাহনের কারনে বেশ কিছুটা দেরি হলো। দুর্গাপুর ঢোকার মুখে আবার টোলগেট পড়লো। সকাল ৮:৩৩ আমরা দুর্গাপুরে। এর পর একে একে অন্ডাল এয়ারপোর্ট ও অন্যান্য এলাকা পর করে অবশেষে আসানসোল, যদিও আসানসোল পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল ৯:০২ হয়ে গিয়েছিলো। এবার ব্রেকফাস্ট করার পালা। শক্তিগড় থেকে আনা কচুরি মিষ্টি দই সহযোগে ব্রেকফাস্ট সেরে ফেললাম। মিনিট ১০ এর বিরতির পর আবার চালু হলো আমাদের নেক্সনের ইঞ্জিন। সকাল ১০:১০ পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে প্রবেশ করলাম ঝাড়খন্ডে। এবার গাড়ির খিদে মেটাতে ঢুকে পড়লাম পেট্রোল পাম্পে। যথারীতি আবার পথ চলা শুরু, কালো হিরের এলাকা ধানবাদকে পাশে রেখে এগিয়ে চললাম আমরা। কিছুটা যাবার পর অবাক হয়ে দেখলাম রাস্তার দুপাশের ল্যান্ডস্কেপ হঠাত্ পাল্টে গেলো। হঠাত্ যেন কেউ সাদা রুক্ষ ক্যানভাসে সবুজের আঁচড় মেরে গেছে। ছেঁড়া ছেঁড়া সবুজ টিলার সমারোহ। গুগুল বাবার শরণাপন্ন হয়ে জানলাম আমরা তোপচাচি পৌঁছে গেছি। রাস্তার পাশে দিক নির্দেশ বোর্ড জানান দিচ্ছে জসিডি, মধুপুর, খুব বেশি দূরে না। এগিয়ে চললো আমাদের গাড়ি। ঠিক করলাম আগামীতে কোন এক সপ্তাহান্তে আসতেই হবে তোপচাচি লেক ঘুরতে। এর পর কইরা তুন্দা, কুলগো আরো নাম না জানা কত জায়গাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চললাম। দূরে সবুজ পাহাড়। ফাঁকা মাঠ । গরুগুলো ট্রেকিং করে পাহাড়ের মাথায় ঘাস খেতে উঠে পড়েছে। দেহাতি মহিলারা মাথায় কাঠের বোচকা নিয়ে চলেছে।
ঝাড়খন্ডের বাগদারা যখন পৌছালাম তখন ঘড়ি জানান দিচ্ছে সময় সকাল ১১:৪৫। আর ঠিক তখনই অঙ্কন এর অফিসের কল। যেহেতু অফিসের কাজ তাই থামতেই হলো। রাস্তার পাশে ঝাড়খন্ড ট্যুরিজম এর একটা বাংলো চোখে পড়লো। আজ বাকি দিনটা এই হোটেলেই কাটাবো ঠিক করলাম। আশ্চর্য ভাবে আগে থেকে বুকিং না থাকতেও পেয়ে গেলাম রুম। এবার আসি বাংলোর বর্ণনায়। প্রায় ১০/১২ কাঠা জায়গার উপর বেশ সাজানো গোছানো বাংলো। রাস্তার একদম পাশে ঝাড়খন্ড ট্যুরিজমের এর বাংলোগুলোর একটা বিশেষ প্যাটার্ন আছে। আমরা এর আগেও ঘাটশিলা গিয়ে থেকেছিলাম তাই সহজেই মিলটা ধরতে পারলাম। বাংলোর সামনে ফুলের বাগান, আমাদের ঘর দোতালায়, সামনে একটা ব্যালকনি ছিল যেখানে দাঁড়ালেই চোখে পরে দূরে পরেশনাথ পাহাড়। এখানে একটাই সমস্যা তা হোলো ইলেকট্রিসিটি ঠিকমতো থাকে না ফলে বাতানুকূল ঘর হওয়া সত্ত্বেও সমস্যা। যদিও রাতে ইলেকট্রিসিটি ঠিক থাকায় কোনো সমস্যা হয় নি। তবে বড়ো বড়ো জানলার জন্য আলো ও হাওয়া বাতাসের কোনো অভাব আমরা অনুভব করি নি। হোটেলের প্রতিটি কর্মীর ব্যবহার ভালো। আমাদের কমপ্লিমেন্টেরি চা ও পাকোড়া খাওয়ায়। এখানে এক রাত কাটিয়ে অফিসের কাজ সেরে পরদিন খুব ভোরে বেরোলাম বেনারাস এর উদ্দেশ্যে। পরদিন ভোর ৪:৫২ তে বেরোলাম।
এখনো ও বাকি ৩৪৪ কিমি। আমরা আশা করেছিলাম সকাল ১১টার মধ্যে খুব ভালোভাবে পৌঁছে যাবো বেনারাস। কিন্তু এবারই শুরু হোলো আসল গল্প। যদিও শুরুতে আমরা কেউ ধারণা করতে পারি নি আমরা কিসের সাক্ষী হতে চলেছি। বেরোনোর মুহূর্তে অঙ্কন বললো অগ্নিপথ প্রোটেস্ট খুব বাজে আকার নিয়েছে। কিন্তু ভাবতে পারি নি এতোটা গভীর সেটা। ভোর ৪:৫২ চারিদিকে আধো অন্ধকার। রাস্তা ফাঁকা আমাদের নেক্সন ছুটে চলেছে। দুপাশে পাহাড় অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ। আমরা যেন টাইম মেশিনে চেপে এক ধাক্কায় পৌঁছে গেছি কোনো নিওলিথিক যুগে। বেশ কয়েকটা ডাইভারসন এর পর ডান দিকে পড়লো গয়া যাওয়ার রাস্তা। তারপর রাঁচি হাজারিবাগ রোড। ঠিক এখান থেকে রাস্তাটি আরো সুন্দর হয়ে উঠলো।
একটা কথা বারবার মনে হতে লাগলো, যদি গাড়ি নিয়ে না আসতাম কত কিছু দেখা অসম্পূর্ণ থাকতো। এ অভিজ্ঞতা ভাষায় বর্ণনা সম্ভব না। দুপাশে ঘনজঙ্গল, নীল, সবুজ পাহাড়ের মাঝে এঁকে বেঁকে চলেছে হাইওয়ে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলার আছে বাগদারার লজ ছাড়ার পর সেভাবে ভালো কোনো হোটেল চোখে পরে নি। তাই যারা আমাদের মতো অফিসের কাজ বা অন্য সমস্যার জন্য ব্রেক করে বেনারাস গাড়ি নিয়ে যেতে চান তারা ঝাড়খন্ড ট্যুরিজমের বাংলোয় রাত্রিযাপন করতেই পারেন, নিরাপদ ও অনেক সাশ্রয়ী। চোখে পড়লো কোবরা বাহিনীর অফিস। জঙ্গল। এরপর মোটামুটি ভালো একটা হোটেল। হোটেল মধুলিকা। যারা আরো কিছুটা এগিয়ে আসতে চান এখানেও থাকার কথা ভাবতে পারেন। তিলাইয়া বাঁধ পেরিয়ে শহরের উপর দিয়ে চলে গেছে রাস্তা। ভোর ৬:২০ চা’র জন্য থামলাম রাস্তার পাশের একটা ধাবায়। চৌপারন রাস্তার আসতেই চোখে পড়লো প্রচুর ক্ষীরমোহনের দোকান। শুনলাম এ অঞ্চলের ট্রাডিশনাল মিষ্টি। এক দোকানে দেখলাম ধোনি মিষ্টি খেয়েছে তার বাঁধানো ছবি।
এরপর ধোবি ব্রিজে ওঠার আগে দাঁড়ালাম কিছু ফল, মিষ্টি কিনলাম। ও হ্যাঁ, আমরা অনেক জায়গা থামতে থামতে গেছি। কারণ আমরা জায়গাগুলো এবং সেখানের মানুষের জীবন বৈচিত্র এসব দেখার জন্য এবং প্রকৃতির পরিবর্তিত রূপকে মনভরে উপভোগ করবো বলে এই পরিকল্পনা। দভি’র কিছুটা আগে একটা রাস্তা বোধগয়া’র দিকে বেঁকে গেছে। এখান থেকে বোধগয়া মাত্র ২০ কিমির মতো সময় লাগে ৩০ মিনিট। আরো বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলে পরবে শেরঘাটি। জায়গাটির ঐতিহাসিক তৎপর্য বেশ চমকে যাওয়ার মতো। এখানে পড়েছিল একটা meteorite পাথর, যা মঙ্গলগ্রহ থেকে পড়েছে বহুবছর আগে। বর্তমানে যা লন্ডন museum এ আছে শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। হয়তো এখানে থাকলে জায়গাটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান হতে পারতো। শেরঘাটি শহরটি শুকনো মনোহর নদী দিয়ে ঘেরা, ঠিক যেন লুপের আকারে বেষ্টিত। এরপর এলো আমাস। আর তারপর শুরু হোলো অন্য রকম গল্প।
সেই সব রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা থাকছে পরবর্তী পর্বে। তার জন্য চোখ রাখতে হবে সংবাদ প্রতিখনে।
বেড়াতে যাচ্ছেন? বেড়াতে গিয়ে আপনার নানা অভিজ্ঞতার কথা ইমেল করে আমাদের দপ্তরে পাঠিয়ে দিন। সঙ্গে নিজের ছবি আর যোগাযোগের নং দিতে ভুলবেন না।
E-mail: editor@sambadpratikhan.com