ভারতের এক অনন্য পুরাকীর্তি

বিশ্ব পর্যটন দিবসে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বিরল এক পর্যটনস্থল নিয়ে কলম ধরলেন সংবাদ প্রতিখনের সম্পাদক স্বরূপম চক্রবর্তী20200712_155839

পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জেলা হুগলি, আর এই হুগলি জেলার উত্তরে অবস্থান করছে যে এলাকা তার নাম বাঁশবেড়িয়া। হাওড়া থেকে ট্রেন পথে যার দূরত্ব ৪৪ কিমি। এই বাঁশবেড়িয়ার অন্যতম দ্রষ্টব্য ভারতের এক অনন্য পুরাকীর্তি হংসেশ্বরী দেবীর মন্দির। যে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন মহারাজা নৃসিংহদেব। মন্দিরের বিস্তারিত বর্ণনের আগে বাঁশবেড়িয়া সম্পর্কে কিছুটা তথ্য দিয়ে নেওয়া ভালো। একটু অবলোকন করা যাক এখনকার প্রাচীন ইতিহাসের দিকে। সপ্তম থেকে দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দে পাল ও সেন শাসন আমলে অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা চলিত হতো মূলত নৌকার মাধ্যমে, ব্যবসা বা বাণিজ্য সবই চলত বজরা বা বড়ো নৌকার মাধ্যমে। প্রধান বন্দর ছিল সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁও, মূলত বাঁশবেড়িয়া, কৃষ্ণপুর, দেবানন্দপুর, নিত্যানন্দপুর, শিবপুর, সম্বোচোরা ও বলদঘাটি এই সাতটি গ্রাম নিয়েই সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁও এর উত্‍পত্তি। আবার কিছু ঐতিহাসিকের মতে বাঁশবেড়িয়া, কৃষ্ণপুর, দেবানন্দপুর, খামারপাড়া, বাসুদেবপুর, শিবপুর ও ত্রিশবিঘা এই সাতটি গ্রাম নিয়েই সাতগাঁও বা সপ্তগ্রামের জন্ম।

১৩২৫ সালে ইতিহাস প্রসিদ্ধ পাগল রাজা মহম্মদ বিন তুঘলক বাংলাকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে লক্ষৌতি, সোনারগাঁও ও সাতগাঁও এই তিন ভাগে ভাগ করেন। যতই ভিন্ন মতবাদ থাকুক না কেনো বাঁশবেড়িয়ার নাম কিন্তু সকল ঐতিহাসিকদের লেখায় উল্লিখিত আছে সপ্তগ্রামের অন্তর্ভূক্ত একটি বিশেষ বর্ধিষ্ণু গ্রাম হিসাবে। বর্ধমানের পাটুলির রাঘব দত্ত রায়কে মুঘল সম্রাট শাহজাহান সপ্তগ্রাম অঞ্চলের ২১টি পরগণার জমিদারী প্রদান করেন, এই দত্ত রায়রাই পরবর্তীকালে দেবরায় উপাধি লাভ করেন।

Untitled-2

রাঘব দত্তরায়ের পুত্র রামেশ্বর দত্ত মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের থেকে রাজা উপাধি পান ও বাঁশবেড়িয়ায় বসবাসের জন্য ৪০১ বিঘা জমি লাভ করেন। সেই সময়ে বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন নবাব শায়েস্তা খাঁ। ১৬৭০ সালে রাজা রামেশ্বর এই ৪০১ বিঘা জমিকে প্রদক্ষিণ করে এক পরিখা কাটান এবং এই পরিখা খননের মাটিগুলি বাঁশবেড়িয়ার রাজবাড়ি বা তার বসতবাটিকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ৫০ হাত উঁচু করে তার ওপর কাঁটাগাছ ও বাঁশগাছ লাগান এবং এই পরিখাকে বলা হয় গড় ও রাজবাড়িকে বলা হয় গড়বাড়ি বা গড়বাটি। বাঁশঝাড়ে ভরা এই এলাকা থেকেই এখানকার নাম হয় বাঁশবেড়িয়া।

gif advt

রামেশ্বরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রঘুদেব ও তার পড়ে তাঁর পুত্র গোবিন্দদেব বাঁশবেড়িয়ার রাজা হন। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভালো রাজা রঘুদেবের ভাইপো মনোহর রায় পত্তন করেন শেওড়াফুলি রাজের। বাঁশবেড়িয়ার রাজা গোবিন্দদেবের পর তাঁর পুত্র নৃসিংহদেব রাজা হন। এই নৃসিংহদেবই ১৭৯২ থেকে ১৭৯৮ সাল বেনারসে এক তান্ত্রিক গুরুর কাছে তন্ত্র বিষয়ে নানা জ্ঞান লাভ করেন এবং এই জ্ঞান লাভের পর তিনি বিলেত যাবার পরিকল্পনা বাতিল করে সিদ্ধান্ত নেন তিনি বংশবাটি বা বাঁশবেড়িয়ায় তন্ত্রমতের ‘ষটচক্র’ ভেদ প্রণালীতে শিব ও শক্তিরূপী এক মন্দির তৈরি করতে মনোনিবেশ করেন, সময়কাল ছিল ১৭৯৮ থেকে ১৭৯৯ সাল। তিনি প্রায় লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে কাশী বা বেনারসের কাছে অবস্থিত চুনারের পাহাড়ী এলাকা থেকে পাথর আনান এবং বেনারস থেকেই অভিজ্ঞ কারিগরদের নিয়ে আসেন মন্দির নির্মাণে। কিন্তু রাজা নৃসিংহদেব নিজে এই মন্দির নির্মানের কাজ পুরো শেষ করে যেতে পারেন নি। নিঃসন্তান এই রাজা ১৮০২ সালে তাঁর পরলোকগমনের পর তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী রানী শঙ্করী ১৮১৪ সালে দেবী হংসেশ্বরী মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ করান ও জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার দিন হংসেশ্বরীর বিগ্রহ স্থাপন করেন ও মন্দির জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।

১৩টি চূড়া বা ত্রয়োদশ রত্ন বিশিষ্ট মন্দিরটি প্রত্নতত্ব বিভাগের হিসাব অনুসারে ২৭.৫ মিটার বা ৯০ ফুট উঁচু, ১৩টি চূড়ার মধ্যের চূড়ার ওপরে রয়েছে ধাতুনির্মিত সহস্রছটার উদীয়মান সূর্য দেবতার প্রতিকৃতি। প্রতিটি মিনারের মাথা এক একটি পদ্মকুঁড়ির আকারে তৈরি। পাঁচতলা এই মন্দিরটির প্রতিটি তলা তন্ত্রমতের এক একটি মূল শাখা যথা – ইড়া, পিঙ্গলা, বজ্রাক্ষ, সুষুম্না এবং চিত্রিনী। রাজা নৃসিংহদেব একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এই মন্দিরের গঠনশৈলীর পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি তান্ত্রিক ষটচক্র ভেদের তত্ত্বটিকে বোঝাতে চেয়েছিলেন এই মন্দিরের স্থাপত্য দিয়ে।20200712_155127 অন্য মন্দিরের যেমন ছাদের প্রতি কোণে বসানো থাকে এক একটি শিখর, এই মন্দিরটি বিভিন্নতল সম্পন্ন শিখরের সমাহরে প্রস্তুত। মন্দিরের পিছনদিকে গর্ভগৃহ থেকে প্রতিটি শিখরে সোপান বা সিঁড়ির সংযোগ রয়েছে। একবার ঢুকলে সহজে বের হওয়া খুবই কষ্টকর। এর প্রকৃত অর্থ, প্রকৃত বা সঠিক গুরুর সাহায্য ছাড়া ‘ষটচক্র’ ভেদ সম্ভব হয় না। মন্দিরের মূল প্রবেশপথে রয়েছে তিনটি খিলানযুক্ত বারান্দা। যার দুদিকে দুটি তিনতলা শিখরভবন। মূল মিনারের একদম ওপরে আছেন শ্বেতশুভ্র মহাদেব। এক হাজার নীল পদ্মের পাপড়ি যুক্ত পদ্মের ওপর আটটি পাপড়িযুক্ত লালপদ্মের ওপর ছয়পাক বেষ্টন করে শুয়ে  আছেন দেবাদিদেব মহাদেব। মহাদেবের নাভি থেকে বের হওয়া পদ্ম ফুলের ডাঁটির ওপর ১২টি লাল পদ্মের ওপর নীলবর্না চতুর্ভুজা দেবী মা হংসেশ্বরী নিজের বাম পা টিকেডান পায়ের ওপর রেখে সিদ্বাসনে বসে। ওপরের বাম হাতে তাঁর অসুর দলনের শক্তি স্বরূপ খাঁড়া, নিচের বাম হাতে নরমুন্ড, আর দুই ডান হাতে অভয়মুদ্রা ও শঙ্খ। নিমকাঠের তৈরি দেবী মূর্তির রং নীল যা সারা ভারতে বিরল।

Untitled-1

মন্দিরের চারিদিকে মাতৃবিগ্রহকে ঘিরে রয়েছে ১২টি কালো শিবলিঙ্গ। মন্দিরের মধ্যে আরও রয়েছে আটহাত বিশিষ্ট মহিষমর্দিনীর দেবীমূর্তি, যা রাজা নৃসিংহদেব স্বপ্নাদেশে রাজবাড়ির কোনও এক পুকুর থেকে পান। মন্দিরের পিছনদিকে গোলকধাঁধার মত সিঁড়ি রয়েছে মন্দিরের ওপরে ওঠার জন্য। ১৩ চূড়ার মন্দিরের গঠনশৈলী অবাক করে, সারা ভারতে এই আজও এক অনন্য পুরাকীর্তি  হিসাবে যা গণ্য হয়।

advt-2

বাঁশবেড়িয়ার অন্য আর এক দ্রষ্টব্য চারচালা একরত্ন ১৬৭৯ সালে হুগলির আরামবাগের কোতলপুর গ্রামের (বর্তমানে যা বাঁকুড়া জেলায়) শিল্পীদের দ্বারা নির্মিত টেরাকোটা শিল্প সমৃদ্ধ ৩৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উঁচু ও ৩২ ফুট ৪ ইঞ্চি চওড়া অনন্ত বাসুদেব মন্দির বা বিষ্ণু মন্দির। যদিও কালের অতলে এবং সরকারী ঔদাসিন্যে আজ তার অধিকাংশই বিলীন। জানা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু এই বাঁশবেড়িয়ায় একমাস থেকে এই মন্দিরের প্রতিটি মৃত্‍ফলকের ছবি এঁকেছিলেন। বাঁশবেড়িয়ার রাজবাড়ি আজও পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষনীয়।

advt-1

যাতায়াত : কলকাতা থেকে সরাসরি গাড়ি আসা যায়, এছাড়াও হাওড়া-বর্ধমান মেন শাখার আদিসপ্তগ্রাম স্টেশন থেকে অটোতে বা হাওড়া–কাটোয়া শাখার ট্রেনে সরাসরি বাঁশবেড়িয়া স্টেশন, স্টেশন থেকেই রিক্সা নিয়ে সহজেই ঘুরে নেওয়া যায় বাঁশবেড়িয়ার এই দুটি বিশেষ দ্রষ্টব্য।

ছবি: দিপান্বীতা দাস, স্বরূপম চক্রবর্তী

advt-5advt-4advt-3

%d bloggers like this: