আত্রেয়ী দো: আজ ধনতেরাস। দোকানের দিকে চোখ রাখলেই দেখা যাবে কেনাকাটার হিড়িক। কিন্তু কেন পালন করা হয় এই উৎসব? রয়েছে নানান মত। চলুন জেনে নিই। ধনতেরাস উৎসবটি মূলত অবাঙ্গালীদের মধ্যে প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে বাঙ্গালীদের মধ্যেও এই উৎসবটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই উৎসবটি পালিত হয় কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের তেরোতম দিন অর্থাৎ ত্রয়োদশীতে। সেই থেকেই কিন্তু এই উৎসবের নাম হয়েছে ধনতেরাস। ধন কথার অর্থ সম্পদ আর তেরাস অর্থাৎ ত্রয়দশী বা ১৩ তম দিন। যদিও এই উৎসব নিয়ে মতভেদের অন্ত নেই।
এই উৎসব প্রচলনের পেছনে যে কারণগুলি রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো একটি লোককথা। শোনা যায় রাজা হিমুর ষোড়শ বর্ষীয় ছেলের কুষ্ঠীতে নাকি লেখা ছিল বিয়ের চতুর্থ দিনের মাথায় তাঁর মৃত্যু হবে। তাঁর স্ত্রী সে কথা জানতে পেরে সেই অভিশপ্ত রাতে তাদের ঘরের বাইরে সোনা-রূপার গয়না,জিনিসপত্র রেখে আসেন। তারপর তিনি তাঁর স্বামীকে ঘুমোতে না দিয়ে তাকে নানান গল্প এবং গান শুনিয়ে জাগিয়ে রাখেন। শোনা যায় যমরাজ নাকি সেই সোনা-রূপার চোখ ধাঁধানো জৌলুসে আকৃষ্ট হয়ে সেখানে বসেই ঘর থেকে ভেসে আসা গল্প,গান উপভোগ করে পরদিন সকালে নিজের কাজ অসম্পূর্ণ রেখে সেখান থেকে চলে যান। এভাবেই চতুরতার সাথে রাজপুত্রের প্রাণ বাঁচান তাঁর স্ত্রী। এই আনন্দেই ধনতেরাসের উৎসব পালন শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে নানান জায়গায়।
অপর একটি লোককথা অনুসারে, দেবতারা ও দানবেরা মিলে যখন সমুদ্রমন্থন করে অমৃতলাভের চেষ্টা করছিলেন তখন অমৃতের ঘরা নিয়ে উঠে আসেন ধন্বন্তরী। তাঁর এক হাতে ছিল অমৃতের পাত্র এবং অন্য হাতে ছিল আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের বই। তাঁকে দেবকূলের চিকিৎসক হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাঁর নামানুসারে এই উৎসবের নাম হয় ধনতেরাস। এখানে ধন কথার অর্থ টাকা-পয়সা নয় এর চাইতেও বড় সম্পদ অর্থাৎ সুস্থ জীবন। এইদিন আসলে পূজিত হন দেবতা ধন্বন্তরী। আয়ুস মন্ত্রকের উদ্যোগে ২০১৬ সাল থেকে এই দিনটিকে ‘আয়ুর্বেদ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়ে আসছে। আয়ুর্বেদের মূল কথাই হলো প্রাকৃতিকভাবে গাছ-গাছাড়ি থেকে ওষুধ প্রস্তুত করে রোগ নিরাময় করা।
তাই হয়তো ধনন্তরীর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের উদ্দ্যেশে প্রাচীনকাল থেকেই ধনতেরাসের পরের দিন অর্থাৎ চতুর্দশীর দিন চোদ্দো শাক খাওয়ার রেওয়াজ চলে আসছে। এই চোদ্দো শাকের মধ্যে নিম,পলতা,হিলঞ্চ, ওল, বেতো,সর্ষে,গুলঞ্চ ইত্যাদি উল্লেযোগ্য। দক্ষিণ ভারতে বিশেষত তামিলনাড়ুতে ব্রাহ্মণ মহিলারা মারুন্ডু নামক একপ্রকার খাওয়ার প্রস্তুত করেন যা সূর্যদয়ের পূর্বে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার সময় ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। জৈন ধর্মে কথিত আছে, এই দিন মহাবীর জাগতিক সমস্ত মায়া ত্যাগ করে ধ্যানস্ত হয়েছিলেন। তাই তারা এই দিনটাকে অত্যন্ত শুভ দিন হিসেবে মনে করেন। ধন্তেরাসে দেবতা ধন্বন্তরীর সাথে সাথে পূজিত হন লক্ষ্মী ও গণেশ। অনেকেই আবার ধন্বন্তরীকে লক্ষী দেবীর ভাই বলে থাকেন। এর পাশাপাশি এদিন পূজিত হন ধন-সম্পদের দেবতা কুবের। বলা হয়ে থাকে এই দিন নাকি সোনা রূপা বা যে কোন ধাতুর তৈরি নতুন কোন দ্রব্য কিনলে মা লক্ষ্মীর কৃপা লাভ হয়। বাড়ির দোরগোড়ায় প্রদীপ জ্বালিয়ে স্বাগত জানানো হয় মা লক্ষ্মীকে।
তবে উৎসব প্রচলনের কারণ যাই হোক, পিছনে লুকিয়ে কিন্তু ব্যাবসায়িক পরিকল্পনা। আসলে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই যুক্তিবাদের থেকে ভাববাদে বিশ্বাসী। তাই,এই ভাবাবেগকে মূলধন করে ব্যবসায়ীরা নিজেদের জায়গা পোক্ত করছে।
আসলে এই সময়টা হলো ঋতুসন্ধিকাল। এই সময় বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাই এই সময় স্বাস্থ্য সম্পর্কে সতর্ক থাকা খুব জরুরী। ধনতেরাস উদযাপনের মধ্যে দিয়ে আরোগ্য লাভের উপাসনা করা হয়। কিন্তু এর সাথে নতুন জামকাপড়, সোনা-রূপার বা অন্যান্য ধাতুর গয়না,বাসনপত্র ইত্যাদি কেনার কতটা যৌক্তিকতা আছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।