সুমিত দাঁ : বাবারা চিরকালই উপেক্ষিত–? কিন্তু কেন? কেনই বা তাঁদের এই পরিনতি? এর কোনও মনঃস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে কি? থাকলে আপনি আমাকে বলতে পারেন উৎসটা কি? কেনই বা বিবাহিত জীবনের পর থেকে আমৃত্যুকাল পর্যন্ত এর দায় এবং দায়িত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে কুঁজো হয়ে বাঁচতে হয়? শেষ জীবনেও শারীরিক অক্ষমতা আর বার্ধক্যের ভারেও স্ত্রী সন্তানদের সুখের কথা ভাবতে ভাবতে দিন যাপনের এই চরম অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হয়? সস্ত্রীক বাবারাই বা কেমন আছেন? বা বিপত্নীক বাবারাই বা কতটা সুখে আছেন? একটু জানতে পারলে আমার লিখতে সুবিধা হয়।
যদিও জানি, সব বাবারাই বুকে পাথর চাপা দিয়ে মনের সত্যি কথাটা বলতে পারেন না। কারণ, ঐ একটাই- মায়াটান। আসলে প্রত্যেক বাবাদের ভেতর লুকিয়ে থাকে আর একটা স্নেহাতুর বাবা। তাই, সংসার নামক কারাগারের বন্দি জীবন থেকে আলোয় বেরিয়ে আসতে বেশ কষ্টই হয়। যা, তাঁর সত্যকে প্রকাশ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। আনুমানিক একশো ভাগের মধ্যে আশি শতাংশ বাবারা এই মনোকষ্টের অসুখে ভুগছেন। কিন্তু কেন? এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমার জানা নেই।
বলাবাহুল্য, বিবাহিত জীবনের পর থেকে যেমন স্ত্রী সন্তানদের প্রতি এবং বাড়ির আর অন্যান্য সদস্যদের প্রতি তাঁর দায় বা কর্তব্য বর্তায় ঠিক তেমনই শুধুমাত্র অর্থনৈতিক পরিকাঠামোতেই আবদ্ধ থাকেন না। সাংসারিক জীবনযাত্রা যাতে সুখের হয় এবং সকলের মুখে হাসি ফোটাতে পারে ফের সেই চিন্তা তাঁকে যেমন প্রতি নিয়ত বিব্রত করে ঠিক তেমনই অবসর যাপন কালেও সেই একই চিন্তার বিস্তার ক্রমশঃ যেন বৃদ্ধি পেতে থাকে। বলাবাহুল্য, পুত্র-কন্যাদের বিবাহের পরও নাতি-নাতনী, স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যাদের কথা ভাবতে ভাবতেই ষাট বছরের প্রবীন ব্যক্তিটিকে যেন নব্বই বছরের বৃদ্ধ মনে হয়।
কারণ, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়-মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে যে সব বাবাদের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ মজবুত তাঁরা এবং যাঁরা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়ে সংসার সংগ্রামে রত তাঁরাও এই উভয় প্রজাতির বাবাদের দুর্দশা প্রায় (কম বেশী) একই পরিনতির মধ্যেই অবস্থান করে। যা তাঁদেরকে শেষ জীবন পর্যন্ত বহন করে যেতে হয়। আসলে বিষয়টা এমনই, যে-পৃথিবীর সমস্ত বাবারাই তাঁদের দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার নিয়েই জন্মান। এর বিকল্প বুঝি আর হয়না বা হতে নেই। পুত্র-কন্যারা বা পুত্রবধূরা যতই চাকরীজীবি বা অর্থনৈতিক বুনিয়াদে সক্ষম হোন না কেন তবুও সেই বাবাদেরকেই দুশ্চিন্তার দায়ে আবদ্ধ থাকতেই হয়। কিন্তু কেন?
হ্যাঁ, মানছি-এ সংসারে মায়েদের ভূমিকাও কম নয়। তাঁরাও সংসারের প্রতি উদাসীন নন। সন্তানের জন্ম দেওয়া থেকে প্রতিপালন পর্যন্ত এবং সংসারের সকলের প্রতি কর্তব্য পালন করলেও তবুও বাবারা যেন বটগাছের মত সকলের মাথায় ছায়া দান করে চলেছেন যুগ যুগ ধরে। তবুও বাবারা যেন মায়েদের থেকে অনেক বেশী উপেক্ষিত। বুকের মধ্যে এই চাপা যন্ত্রনা নিয়েই বাঁচতে হয় বাবাদের। বয়সকালে তাঁদের প্রতি কর্তব্য পালনে সন্তানদের (পুত্র এবং পুত্রবধূদের) বদান্যতা ঠিক যেন অনেকটা পদ্মপাতায় জলের মতন টলমল করতে থাকে। কখন কি হয়। সবটাই সময় আর তাদের মানসিক বিবর্তনের ওপর ঝুঁকি সাপেক্ষ।
তাই বয়সকালে বাবাদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। যতই তাঁদের আর্থিক সঙ্গতি থাকুক না কেন বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সন্তান বা বৌমাদের কাছে মা হয়ে ওঠেন সংসারের কাজের লোক এবং বয়স্ক বাবারা হয়ে যান ব্রাত্য। আর যদি তাঁদের পুত্র সংখ্যা একের অধিক হয় তাহলে সেই সংসারে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
আর এই দ্বন্দ্বের জেরে বাবা-মা’ এরা হয়ে যান ভাগের ‘মা’ ভাগের বাবা। তখন বাবা-মায়েরা সংসারের ভাঙন রুখতে দিশেহারা হয়ে পড়েন, এবং সন্তানদের বিভেদকামী মানসিকতার জেরে তাঁরা অবসাদে ভুগতে থাকেন। পরিশেষে তাঁরা নানা রকম রোগ-ব্যধির শিকার হন। আমার মত যাঁরা প্রাচীনপন্থী আছেন তাঁরা নিশ্চয়ই দেখেছেন বা জানেন যে-তদানীন্তন পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় একান্নবর্তী পরিবারগুলি একজন কর্তার অনুশাসনে পরিচালিত হত। যা তাঁদের পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি এমন কি নৈতিক চরিত্র গঠনেও সাহায্য করত। তৎকালীন সময়ে মা-ঠাকুমা, বাবা কাকা, জেঠা-জেঠী, ভাই-বোন, আত্মীয় পরিজন প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠত। যা আজকের এই যান্ত্রিক যুগে বিলুপ্ত প্রায়।
আমি প্রসঙ্গ থেকে হয়তো কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক আলোচনায় চলে এসেছি। যাহোক, বস্তুতপক্ষে, বর্তমান সময় তৎকালীন সময়ের সম্পূর্ণ পরিপন্থী হলেও বাবারা সেই অন্তরালেই রয়ে গেলেন। বার্ধক্যজনিত কারণে বাবারা অথর্ব হয়ে গেলে তাঁরা যে কতটা অসহায় হয়ে পড়েন তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আমি নিজে একজন বিপত্নীক বাবা। তাই নিজেকে দিয়ে বিশ্লেষণ করার এই সুযোগটাকে হাতছাড়া করতে পারলাম না। পরবর্তী অধ্যায়ে আরও লেখার ইচ্ছা রইল।