করবা চৌথ কী ও কেন

সারা দেশে আজ পালিত হচ্ছে লোকচারের অন্যতম এক প্রধান উত্‍সব করবা চৌথএই লোকচারের বিষয়ে আলোকপাতে সাংবাদিক আত্রেয়ী দো

আজ করবা চৌথ। সাধারণত বাঙালি হিন্দুধর্মীদের মধ্যে প্রচলিত না হলেও হিন্দি সিনেমা বা সিরিয়ালের দৌলতে করবা চৌথের সাথে আমরা সকলেই প্রায় কমবেশি পরিচিত। আজ এই করবা চৌথ সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জেনে নিই চলুন।

মূলত উত্তর ও পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলিতে অর্থাৎ পাঞ্জাব,হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ,হিমাচল প্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যে এই লোকাচারটির প্রচলন রয়েছে। তবে বর্তমানে সিরিয়াল – সিনেমার দৌলতে এই লোকাচারের প্রচলন বহুগুণ বেড়েছে,ছড়িয়েছে সর্বত্র। অনেকেই এই লোকাচারটিকে শিবরাত্রির সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। কারণ এদিনও স্ত্রীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় সারাদিন নির্জলা উপবাস রাখেন। সারাদিনের উপবাসের পর, চালুনির মধ্যে দিয়ে প্রথমে চাঁদ দেখা এবং তারপর নিজের স্বামীর মুখ দেখে স্বামীর হাতে জল খেয়েই উপবাস ভঙ্গ। এভাবেই পরম্পরায় চলে আসছে এই করবা চৌথের রীতি।কার্তিক মাসের প্রথম পূর্ণিমার পরে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থীর দিন পালন করা হয় এই করবা চৌথ।

এই লোকাচারের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে নানান কাহিনী,যদিও তা মতভেদে ভিন্ন ভিন্ন।

‘করবা’ কথার অর্থ মাটির পাত্র এবং ‘চৌথ’ মানে চতুর্থ। ওখান থেকেই নামকরণ করা হয় ‘করবা চৌথ’। আসলে এই সময়ে রবিশস্যের চাষ শুরু হয়। গমের দানা বপন করার আগে বড় বড় পাত্রের মধ্যে গমের দানাগুলি রাখা হয়। এই পাত্রগুলিকে বলা হয়ে করবা। একদলের মতে, এই ব্রত পালনের মূল উদ্দেশ্য ছিল শস্য,মূলত গম যাতে ভালো উৎপাদন হয় সেই কামনায়। যেসব রাজ্যে গম উৎপাদন ভালো হয় মূলত সেই রাজ্যেই কিন্তু এই করবা চৌথের প্রচলন ছিল। তবে বর্তমানে এই প্রথার বিস্তার হয়েছে।

অপর একদলের মতে, আগে খুব কম বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। বিয়ের পর বহু দূরে শ্বশুর বাড়ি চলে যাওয়ার কারণে বাপের বাড়ির সাথে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত তারা। তারা যাতে নতুন করে তাদের বন্ধু খুঁজে নিতে পারে,সেই কারণে এই অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।

এই ব্রতে কড়াইয়ের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। জানা যায় যারা এই ব্রত করেন তারা নাকি নতুন কড়াই কেনেন এবং তাতে নতুন বস্ত্র,সাজসরঞ্জাম,বিভিন্ন রকম সুস্বাদু খাবার,মিষ্টি ইত্যাদি রেখে সেই কড়াই একে অপরের সঙ্গে আদান-প্রদানের একটি রীতি রয়েছে। আবার জানা যায়,পেশায় সৈনিক স্বামীর জন্য উদ্বিগ্ন, অপেক্ষারত স্ত্রীরা স্বামীদের মঙ্গল কামনায় এই ব্রত রাখতেন। তবে,বর্তমানে সকল ধর্ম,পেশা নির্বিশেষে বিবাহিত মহিলারাই এই ব্রত করে থাকেন।

এই উৎসবের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে নানান লোককথাও।

শোনা যায় রানী বীরবতী তার পিতার গৃহে একবার করবা চৌথের উপবাস রেখেছিলেন। কিন্তু উপবাসরত বোনের ক্ষুদা-তৃষ্ণায় কাহিল অবস্থা দেখে তার সাত ভাই অশ্বত্থ গাছের সাথে আয়না বেঁধে এমন ভাবে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন যাতে মনে হয় আকাশে চাঁদ উঠেছে। রানী বীরবতী আয়নাকে চাঁদ ভেবে ভুল করে উপবাস ভঙ্গ করেন। শোনা যায় তিনি উপবাস ভঙ্গ করার সাথে সাথেই তার স্বামীর মৃত্যু হয়। স্বামীর মৃত্যুর খবরে শোকাহত রানী বীরবতি পুনরায় করবা চৌথের ব্রত রাখেন এবং তা সম্পূর্ণ করে যমরাজকে সন্তুষ্ট করেন। যমরাজের আশীর্বাদে তার স্বামী পুনর্জীবিত হন। এভাবেই এই উৎসবের প্রচলন হয়।

অন্য আরেকটি লোককথা অনুযায়ী, করবা নামে এক সতী নারীর কথা জানা যায়। তিনি নাকি যমরাজের আশীর্বাদে কুমিরের কবল থেকে তার স্বামীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। সেই থেকেই এই উৎসবের নাম হয়েছে করবা চৌথ।

জানা যায়, মহাভারতেও এই ব্রতের উল্লেখ আছে। শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে দ্রৌপদী তাঁর পঞ্চস্বামীর মঙ্গল কামনায় এই করবা চৌথ ব্রত রাখেন। আসলে একবার অর্জুন নীলগিরি পর্বতের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পর তার বাকি ভাইয়েরা সমস্যায় পড়ে। তখন দ্রৌপদী কৃষ্ণের শরণাপন্ম হলে , কৃষ্ণ তাকে মাতা পার্বতীর কথা বলেন। মহাদেব সমস্যায় পড়লে পার্বতী মহাদেবের জন্য এই করবা চৌথ ব্রত রেখেছিলেন এবং এর পরে মহাদেব সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। এই কথা শুনে দ্রৌপদী করবা চৌথ ব্রত পালন করেন।

তবে প্রচলনের কারন যাই হোক না কেন এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্যই হলো স্বামীর মঙ্গল ও দীর্ঘায়ু কামনা।

এই ব্রতের নিয়ম হলো সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অবধি নির্জলা উপবাস। সূর্যোদয়ের আগেই খাওয়ার খেয়ে নেন ব্রতীরা। অনেক জায়গায় এইদিন ব্রতীদের জন্য এই খাবার তাদের শাশুড়িমাই বানিয়ে দিয়ে থাকেন। সন্ধ্যে থেকে উৎসব শুরু হয়। নতুন পোশাক, অলংকার,মেহেন্দিতে সজ্জিত স্ত্রীরা এক জায়গায় জড়ো হন ব্রত উদযাপনের উদ্দেশ্যে। এই দিন পরিধেয় হিসেবে লাল,হলুদ কিংবা সোনালী রঙের পোশাকই বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়। মনরঞ্জনের অংশ হিসেবে চলে গান বাজনা। পাশাপাশি চলে ব্রতকথা পাঠ। এরপর আসে সেই কাঙ্ক্ষিত সময়। আকাশে চাঁদের উদয় হলে, প্রদীপের আলোয় প্রজ্বলিত চালুনির মাধ্যমে চাঁদ দেখে, চন্দ্রদেবের কাছে নিজেদের স্বামীদের মঙ্গল ও দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করা হয় এবং তারপর স্বামীর মুখ দেখে ব্রত সমাপ্ত হয়। এদিন আরাধনা করা হয় শিব,পার্বতী,গণেশ ও কার্তিকের। স্বামীরা স্ত্রীদের জল খাইয়ে তাদের উপবাস ভঙ্গ করেন।

এই উৎসব অনুষ্ঠানগুলোর সাথে জড়িয়ে রয়েছে বহু মানুষের আবেগ,ভালোবাসা। অটুট থাকুক স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক, সুখী হোক সবার দাম্পত্যজীবন। প্রাণখুলে মেতে উঠুন করবা চৌথের উৎসবে।

%d bloggers like this: