টাউন ক্লাব

১৩৯ বছর অতিক্রম করে সগৌরবে পথ চলছে কলকাতা ময়দানের টাউন ক্লাবএই ক্লাবের ইতিহাস নিয়ে কলম ধরলেন

কিশলয় মুখোপাধ্যায়

এখন ভারতে চলছে পুরুষদের একদিবসীয় বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর। শনিবার হয়ে গেল এই বিশ্বকাপের কলকাতার ইডেনে বিশ্বকাপের ২৮ তম ম্যাচটি। এবারের বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল সহ মোট ৫টি ম্যাচ হবে ইডেন উদ্যানে। কলকাতা তথা বাংলা এবং এখনকার বাংলাদেশে এই যে ক্রিকেটের প্রতি উৎসাহ এটা শুরু হয়েছিল টাউন ক্লাবে এবং বাংলার ক্রিকেটের জনক সারদারঞ্জন রায়ের তত্বাবধানে। ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় টাউন ক্লাব। টাউন ক্লাব মূলত সেরা খেলাটা খেলেছে ক্রিকেটে। এছাড়া হকিতেও ভালো টিম তৈরি করেছিল। ময়দানের খেলার কথা হবে আর ফুটবল থাকবেনা তাতো হতে পারেনা। মোহনবাগান, ইষ্টবেঙ্গল, মহামেডানের মতো না হলেও ফুটবলে কয়েকটি সেরা ম্যচ খেলেছে। আর ছিল অ্যাথলেটিকস । তবে মূলত নাম ছিল ক্রিকেট আর হকিতে। সারদারঞ্জন রায় কলকাতার মতো ঢাকাতেও ক্রিকেট খেলা শিখিয়েছিলেন। বলা যায় আজ বাংলাদেশের ক্রিকেটের সলতে পাকিয়েছিলেন বা়ংলার ডব্লু জি গ্রেস সারদারঞ্জন।

গোবরডাঙার গঙ্গাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক বিপিন বিহারী গুপ্ত, রায়বাহাদুর মন্মথনাথ মিত্র, নাটোরের মহারাজা, সারদারঞ্জন রায়, ময়মনসিংহের মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য সহ আরো খ্যাতনামা মানুষের পৃষ্ঠপোষকতায় ও আর্থিক সহযোগিতায় টাউন ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। সারদারঞ্জন রায়ের নেতৃত্বে শুরু হয় ক্রিকেট প্রশিক্ষন ও অনুশীলন আর শুরু হয় প্রতিভা অন্বেষণ। এক্ষেত্রে উৎসাহ দেন ক্লাবের সম্পাদক অধ্যাপক বিপিন বিহারী গুপ্ত, আচার্য রাজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী সহ আরো অনেক উৎসাহী তরুণ । তখন ক্রিকেট নিয়ে এক উন্মাদনা। সদস্য সংখ্যা বছর বছর এত বাড়তে লাগলো আর ক্রিকেট নিয়ে এমন ‘ক্রেজ’ দেখা গেল যে ১৯০৪-০৫ দু বছর নতুন সদস্য নেওয়া বন্ধ রাখতে হয়েছিল।

ময়দানে ইংরেজদের ডালহৌসি এসি, ক্যালকাটা ক্লাব, ও ন্যাভাল ভলিন্টিয়ার্স যা পরে নাম হয় ক্যালকাটা রেঞ্জার্স ক্লাবের পাশে প্রথম ভারতীয় তথা বাঙালি ক্লাবের তাঁবু প্রতিষ্ঠিত হল। ইংরেজ ক্লাব ক্যালকাটা প্রথম বাঙালি ক্লাব টাউন ক্লাবের সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচ খেলে। এরপর জি এফ ভার্নানের অধিনায়কত্বে ইংল্যান্ডের ক্লাব ১৮৮৯-৯০ সালে টাউন ক্লাবের সঙ্গে খেলে। এরপর ইংল্যান্ড থেকে লর্ড হকের নেতৃত্বে টিমের সঙ্গে ও পাতিয়ালার মহারাজা টিমের সঙ্গে টাউন ক্লাব লড়াকু ক্রিকেট খেলে। এই মহারাজা টিমে ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের জনক রনজিত সিংজি। লর্ড হক ও রনজিত সিংজিকে টাউন ক্লাব বিপুল সংবর্ধনা দেয়। এতে সদস্যদের দ্বিগুন উৎসাহ বাড়ে। তখন অবশ্য খেলা হত কম আর প্রথম দিকে ইংরেজরা ভারতীয়দের সঙ্গে খেলতে চাইতনা। ভাবত নেটিভরা  ক্রিকেট কী খেলবে।

যাইহোক নিয়মিত অনুশীলন, ম্যাচ আর অবিরাম প্রয়াস টাউন ক্লাব ক্রিকেটে সফল ভাবে আত্মপ্রকাশ করল আর এই ক্লাব উপহার দিল তৎকালীন সেরা সেরা খেলোয়াড়। যেমন মুক্তিদারঞ্জন রায়, কুলদারঞ্জন রায়, এরিয়ান ক্লাবের প্রাণপুরুষ দুখীরাম মজুমদার জে লাহিড়ী মনমোহন মিত্র, যোগেন ভট্টাচার্য  প্রমুখ সহ আরো অনেকে। আর অবশ্যই  সারদারঞ্জন রায়। আজ অনেকেই বিস্মৃতির আড়ালে। মুক্তিদারঞ্জন রায় বল পেটাতেন খুব। ইডেনে ক্যালকাটা ক্লাবের বিরুদ্ধে ৯২ রান করেছিলেন। সেই ইনিংসে ৬টা ৬ ছিল। এত জোরে মারতেন যে একবার ইডেনে স্টেডিয়ামের বাইরে বল পাঠিয়েছিলেন। তখন এরকম হিট করতে পারতেন লর্ড হক। জে লাহিড়ী হলেন প্রথম বাঙালি ক্রিকেটার যিনি ইডেনে টাউন ক্লাবের হয়ে ৯৭ রান করেছিলেন। মনমোহন মিত্র, যোগেন ভট্টাচার্য ব্যাটসম্যান হিসেবে নাম করেছিলেন।

মুক্তিদারঞ্জন রায় ছিলেন দুর্ধর্ষ ফিল্ডার আর এই গুনটা কাজে লাগালেন অ্যাথলেটিকসে। তিনি ও আরো কয়েকজন টাউন ক্লাবকে অ্যাথলেটিকসে সেরা স্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন ছিল লী অ্যাথলেটিকস স্পোর্টস যা পরে নাম হয় ক্যালকাটা অ্যাথলেটিকস স্পোর্টস। এই প্রতিযোগিতায় মুক্তি বাবু ১০০ গজ দৌড়ে ১০.২ সেকেন্ড সময় নিয়েছিলেন। এই রেকর্ড অনেকদিন পর্যন্ত ছিল। ১০০ গজ, ২২০ গজ দৌড় ও থ্রোয়িং দি উইকেট এই  তিনটি বিভাগে মুক্তি বাবু বরাবর প্রথম স্থান পেতেন।

ফুটবলে টাউন ক্লাবের সেরা সময় ছিল ১৯৩৫ থেকে ৪৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৩৭ সালে মহমেডান কে হারিয়ে কোচবিহার কাপ জয় করে । আজীমগঞ্জের নওলখা শীল্ড, কলকাতায় লক্ষ্মী বিলাস কাপ, গিরিজা মেমোরিয়াল শীল্ড জিতেছিল। এছাড়া চুঁচুরায় গ্ল্যাডস্টোন কাপে মোহনবাগানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ান হয়।

তখন ভালো হকি স্টিক পাওয়া যেতনা। বাইরে থেকে ওক গাছের কাঠের মজবুত হকি স্টিক আমদানি করা হত। তাই দিয়ে দুর্ধর্ষ হকি খেলত টাউন ক্লাব। প্রথম বাঙালি হকি টিম হল এই ক্লাব। প্রথম ম্যাচ খেলে রেভারেন্ড হুইটলের নেতৃত্বে রাঁচির সেরা হকি টিমের সাথে। সেই ম্যাচ দেখতে এসেছিল অগুনতি দর্শক। প্রায় ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে টাউন ক্লাব হকি খেলেছে।

স্বামী বিবেকানন্দ থেকে চিত্তরঞ্জন দাস প্রমুখ প্রাতঃস্মরণীয় মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছে এই ক্লাব। টাউন ক্লাব মানে কলকাতা তথা বাংলা ক্রিকেটের হাতেখড়ি ও উত্থান। অতীতে খেলাধুলো জগতে বাঙালিকে দেখিয়েছে সাফল্য তথা প্রতিষ্ঠিত হবার রাস্তা। টাউন ক্লাবের টেন্ট এখনও ময়দানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। টাউন ক্লাব এখনও ক্রিকেট খেলে। এই বছর ঐতিহ্যবাহী পি সেন ট্রফিতে কোয়ার্টার ফাইনালে ভবানীপুরের কাছে ৪ উইকেটে পরাজিত হয়েছে। খেলায় জয় আর পরাজয়তো থাকবেই। আসল কথাটা হচ্ছে ১৮৮৪ সাল থেকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ক্রিকেট খেলছে শতাব্দী প্রাচীন এই ক্লাবটি।

%d bloggers like this: