বিস্মৃতির আড়ালে বাঙালি খেলোয়াড়গণ

এই বাংলা জন্ম দিয়েছে বহু বিখ্যাত মানুষদের। বিভিন্ন ক্ষেত্রের নানা গুণী মানুষেরা এই বাংলা থেকেই সারা বিশ্বে নিজেদের রাজ্যের নাম উজ্জ্বল করেছেন। খেলাধূলার ক্ষেত্রেও কিন্তু কোনদিনই পিছিয়ে ছিল না এই বাংলা। আমাদের এই বাংলার কয়েকজন কৃতী ক্রিকেটারের স্মৃতিচারণ করলেন কিশলয় মুখোপাধ্যায়  

ক্রিকেটের হাতেখড়ি

সারদারঞ্জন রায়ের ভাইঝি লীলা মজুমদার এক ক্রীড়া পত্রিকার লেখায় লিখেছিলেন ‘বড় জ্যাঠামশাইয়ের লম্বা দাড়ি, মজবুত চেহারার সঙ্গে বিশেষ করে যখন হাতে ব্যাট আর পায়ে প্যাড থাকত, বিলিতি ক্রিকেটার স্বনামধন্য ডব্লু জি গ্রেসের সঙ্গে চেহারার কোন তফাৎ থাকতোনা’। ইউরোপিয়ান ক্রিকেট মহলে ‘বাংলার গ্রেস’ নামেই পরিচিত ছিলেন সারদারঞ্জন রায়। বাঙালিকে ক্রিকেট খেলা শিখিয়েছিলেন তথা উৎসাহিত করেছিলেন। শুধু বাংলা কেন বাংলার বাইরেও ক্রিকেট শিখিয়েছেন অধ্যাপক ও ক্রিকেটার ‘বাংলার ডব্লু জি গ্রেস’। তিনি ইষ্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রথম সভাপতি ছিলেন। অবশ্য আগে ক্রিকেট খেলা হতোনা তা নয়, তবে খেলতেন ইংরেজরা। বাঙালিকে তথা ভারতীয়দের ক্রিকেটের প্রতি প্রবল উৎসাহিত করেছিলেন সারদারঞ্জন রায়।

সারদারঞ্জন রায়ের নিজের ক্রিকেটের হাতেখড়ি হয় কিশোরগঞ্জে মাইনোর স্কুলে পড়ার সময়। তখন কিশোর বয়স, অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। অংক আর সংস্কৃত বিষয় ছিল তাঁর অসাধারণ ব্যুৎপত্তি। পরবর্তী কালে অংকের অধ্যাপনা শুরু করেন। প্রথমে যোগ দেন আলিগড় মহামেডান অ্যাকাদেমিতে যা এখন আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়। আর এখান থেকেই ক্রিকেট শেখানো শুরু। এরপর বহরমপুর, তারপর ঢাকা, অবশেষে কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজ। তখন অবশ্য নাম ছিল মেট্রোপলিটান ইনস্টিউট। আর বিদ্যাসাগর মহাশয়ই তাঁকে অধ্যাপনার জন্য আমন্ত্রন জানায়। মাঝে কিছুদিন কটকে অধ্যাপনা করেছেন। আর প্রতিটি জায়গায় পড়ানোর পাশাপাশি ক্রিকেট শিখিয়েছেন। নিজে খেলেছেন। কলকাতায় কয়েকজনের সঙ্গে টাউন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করলেন। এছাড়া বিদ্যাাগর অ্যাথলেটিক্স ক্লাব ও নাটোরের ক্রিকেট দল গড়ে তুলেছিলেন। খেলোয়াড় হিসেবে তিনি ব্যটিং এর থেকে বোলি়ং এ বেশি দক্ষ ছিলেন। তিনি মিডিয়াম পেস বোলার ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের সব সময় বলতেন  শরীরের ওপর নজর নিতে, সোজা ব্যাটে খেলতে আর লেংথ মেপে বল করতে হবে। ১৯২৫ সালে জীবনাবসান হয় বাংলা ক্রিকেটের জনকের।

অফস্পিন বোলিং

সময়টা ১৯২২-২৩সাল। বেসরকারি উদ্যোগে সর্বপ্রথম ত্রিদলীয় আন্ত প্রাদেশিক ক্রিকেট প্রতিযোগিতার আসর বসেছে নাগপুরে। খেলা চলছে তখনকার দিনে দুর্ধর্ষ মধ্যপ্রদেশ ও মাদ্রাজ সন্মিলিত টিম আর অপরদিকে বাংলা। সেই ম্যাচে বাংলা এক ইনিংসে ম্যাচটি জেতে। সেটা সম্ভব হয়েছিল এক বাঙালির দুরন্ত অফস্পিন বোলিং এ। ১৫ রানের বিনিময় ৭টি উইকেট নিয়েছিলেন। এই দুরন্ত অফস্পিনারটি হলেন হেমাঙ্গ বসু। আর তাকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিলেন শৈলজা রায়। বাংলা দল হলেও বাঙালি ছিলেন তিনজন। এই দুজন ছাড়া আরেকজন হলেন টগর মুখোপাধ্যায়। বাকি সব ছিলেন ইংরেজ খেলোয়ার। তখনকার দিনে এটাই স্বাভাবিক। আরেকটা ব্যাপার হল এখনকার দিনের মতো তখন এত খেলাও হতোনা। অফব্রেক সম্পর্কে বিখ্যাত ধারাভাষ্যকার ও সাংবাদিক অজয় বসুকে তিনি বলেছিলেন যে ‘১৩-১৪ বছর বয়সে আমি ক্রিকেট বল প্রথম হাতে নিয়েছিলাম। এবং সেদিনই লক্ষ্য করেছিলাম হাত থেকে মাটিতে পড়ার পর বল আপনা আপনি অফব্রেক করছে। চেষ্টা করে যে আমায় অফব্রেক বল যে দিতে হয়েনি তার জন্য নিজেক ভাগ্যবান বলে মনে করি।’

হেমাঙ্গ বাবু দুবার ১০টি উইকেট পেয়েছিলেন। বোলিং এর সঙ্গে ব্যাটিং ও ফিল্ডিং এও দক্ষ ছিলেন। তাঁর কভার ড্রাইভ ছিল দেখার মতো। ১৯২৪ সালে ইবিআর বিপক্ষে খেলার সময় একা ৮টি ক্যাচ ধরেছিলেন। সেই পারফরম্যান্স দেখে মাঠে উপস্থিত রেলের অফিসাররা তাঁকে রেলে চাকরি দিলেন। এই ফিল্ডিং দক্ষতার জন্যই কোচবিহার দলে খেলার আমন্ত্রন পান। তিনি খেলেছেন স্পোর্টিং ইউনিয়ন, মোহনবাগান, ইষ্টবেঙ্গল, বিদ্যাসাগর কলেজ, ঢাকা ইষ্ট এন্ড ক্লাব, ভিক্টোরিয়া, ঢাকা কলেজ, এবং ময়মনসিংহের পণ্ডিত পাড়া টিমে। তিনি খেলা শিখেছিলেন সারদারঞ্জন রায়, শৈলজা রায় ও এরিয়ানের প্রাণপুরুষ  দুঃখিরাম বাবুর কাছে। আরেকজনের নাম বলতে হয় তিনি হলেন গ্রামের স্কুলের শিক্ষক নীলকান্ত বসু। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এঁদের কথা বার বার বলতেন। ১৯৫৬ সালে হেমাঙ্গ বসুর দেহাবসান হয়।

ফিল্ডিং

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের সময়কাল। তখন ভারতীয় ক্রিকেটে কোচবিহারের রাজার দল  আর নাটোরের রাজার দলের মধ্যে নিয়মিত ম্যাচ হতো। দুই দলেই  ভারতীয় ও ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্লাবের তখনকার সেরা সেরা খেলোয়াড়রা খেলতেন। সেই রকম একটি ম্যাচে এক বাঙালির দুর্ধর্ষ ফিল্ডিং দেখে সবাই মুগ্ধ। মুগ্ধ তৎকালীন অন্যতম ইংরেজ ক্রিকেটার তথা সামারসেট কাউন্টি টিমের অধিনায়ক ড্যানিয়েল। এই বাঙালি খেলোয়ারটি হলেন বিধুভূষণ মুখোপাধ্যায়। ড্যানিয়েল বলতে বাধ্য হলেন যে ‘বিধু যদি ইংল্যান্ডে থাকতেন তাহলে শুধু মাত্র ফিল্ডিং এর গুণেই তিনি যেকোন সেরা কাউন্টি দলে স্থান পেতেন।’ ড্যানিয়েল এসেছিলেন কোচবিহার রাজার পুত্রের শিক্ষক হিসেবে। উইকেটের কাছে স্লিপে ফিল্ডিং করতেন বিধু বাবু। এরিয়ান ক্লাবের দুঃখিরাম বাবু বিধুভূষণকে খুঁজে বের করেন।

বিধু বাবু বেশীরভাগ সময়টা এরিয়ানেই খেলেছেন। এরিয়ান ইংরেজদের ক্লাব বালিগঞ্জের সঙ্গে প্রথম খেলে ১৯০৫ সালে। সেই খেলায় ৪৮ রান করেছিলেন ও ৪টি উইকেট পেয়েছিলেন। তিনি একাধিকবার শতরান করেছেন। ইংরেজদের আরেকটি ক্লাব ক্যালকাটার বিপক্ষে ইডেনে পরপর দুটি ম্যাচে ১২৮ ও ১১২ রান করেন। তখন ইডেনের মাঠে শতরান করা ছিল অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয়। তবে তখন কেন এখনও যে কোন স্তরের খেলায় ব্যাটসম্যানের কাছে শতরান করা কৃতিত্বের বইকি।

স্বাভাবিক ভাবে ভালো খেলার জন্য কোচবিহার রাজপ্রাসাদ থেকে আমন্ত্রন আসে। তিনি সেই দলে যোগ দিলেন। দার্জিলিং সফরে প্ল্যান্টার্স একাদশের বিরুদ্ধে ২টি খেলায় সেঞ্চুরি করেন। পুনেতে একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী খেলা হয়েছিল কোচবিহার ও বোম্বে গভর্নর দলের মধ্যে। সেই ম্যাচে বিধুভূষণ বাবুর বোলিং, ফিল্ডিং ও ব্যাটিং দেখে দর্শকুল মুগ্ধ। ইডেনে তাঁর সর্বোচ্চ রান নটআউট ১৪৮ রান। ১৯২১ সালে এই দক্ষ অলরাউন্ডারের জীবনাবসান হয়।

তখন পরাধীন ভারতবর্ষ। বেশিরভাগ খেলোয়াড় ইংরেজ। ম্যাচও কম হতো। এর মধ্যে কয়েকজন বাঙালি খেলায় দক্ষতার ছাপ রেখেছিলেন। বিখ্যাত সাংবাদিক অজয় বসু যথার্থ বলেছিলেন ‘যে ভারতীয় ক্রীড়া রসিকদের হৃদয়ে ক্রিকেটকে রাখার জন্য এই সব বাঙালি দক্ষ খেলোয়াড়দের অবদান অনস্বীকার্য।কিন্তু এরা অন্তরালেই থেকে গেলেন।’

তথ্য ঋণ : ক্রীড়া জগতে দিকপাল বাঙ্গালী- অজয় বসু
%d bloggers like this: