কলকাতা ছাড়িয়ে বনেদি বাড়ির পুজোর সুলুক সন্ধান

আমাদের এই বাংলার নানান প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে নানা প্রাচীন বনেদি বাড়ির ঐতিহাসিক দেবী আরাধনার ইতিহাস। আজ থেকে সংবাদ প্রতিখন আপনাদের জন্য নিয়ে আসছে সেই সকল বনেদি বাড়িগুলির দুর্গাপুজোর ইতিহাস। 

লিখছেন কিশলয় মুখোপাধ্যায়।  আজ পঞ্চম পর্ব

নাগেদের বাড়ির দুর্গাপুজো

 

”শরৎ এসে গেছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের হাতি ভেসে যাচ্ছে শুঁড় তুলে। দক্ষিণের জমিতে ঝাঁকড়া একটা শিউলি গাছ। সবে ভোর হচ্ছে। আকাশ থেকে অন্ধকারের পাতলা সর সরে  যাচ্ছে। দিন যে চোখ রগড়াচ্ছে। সেই পাতলা আলোর শিউলি গাছের তলায় একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ফুল কুড়োচ্ছে…. ছেলেটির নাম জয়, আর মেয়েটির নাম জয়া। এক জোড়া ভাই, বোন।ফুলের মতো সুন্দর।”… বিখ্যাত সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখা শিউলি গল্পটি এই ভাবে শুরু হচ্ছে। শরৎ, শিউলি ফুল আর ভোরের এই পরিবেশ মানেই দুর্গাপুজো। গুড়াপ গ্রামের নাগেদের পাড়ায় নাগ বাড়ির দুর্গা প্রতিমার রং হয় শিউলি ফুলের বোঁটার রঙের মতো। রামদেব নাগ প্রতিষ্ঠিত এই পুজোর দুর্গাপ্রতিমার বাঁদিকে বিরাজমান বিনায়ক গণেশ। আর ডানদিকে রয়েছে দেবসেনাপতি কার্তিক। নবপত্রিকা রয়েছে কার্তিক দেবের পাশে। এই পুজোয় আরও বৈশিষ্ট হল চালচিত্র ও অস্ত্রপুজো। দুর্গাদালানের একটু দূরে রয়েছে বিখ্যাত গনিত শিক্ষক কে.সি.নাগের বাড়ি। বাড়িটির নাম কেশব ধাম। আর রয়েছে গুড়াপ রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম।

 

নাগেদের বাড়ির পুজোর চালচিত্রের জৌলুস আগের মতো না থাকলেও কিছুটা এখনও আছে। আসলে সর্বত্র চালচিত্রের সেই জৌলুস কবেই ফিকে হয়ে গেছে। আগে কী দিন ছিল চালচিত্রের। বৃন্দাবনি, রামচন্দ্রী, দশাবতারী, দোথাকি, ইন্দ্রানী এরকম কতরকমের চাল ছিল। দিনের পর দিন শিল্পীরা চালচিত্র আঁকতেন। চণ্ডী বর্নিত নানা ঘটনা। বিরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়ার নানা কাহিনী। সেরকম নাগ বাড়ির পুজোর চালচিত্রে রয়েছে রাধাকৃষ্ণ, নরসিংহ কর্তৃক হিরণ্যকশিপু বধ আর প্রল্হাদের কড়জোড়ে দণ্ডায়মাণ, তরোয়াল হাতে নির়ে নীল বর্ণের দুর্গা।

সপ্তমীর দিন প্রত্যেক সেবাইতের বাড়ি থেকে কুলোয় সাজানো লক্ষ্মী দেবীকে মণ্ডপে দুর্গা প্রতিমার পাশে রাখা হয়। দশমীর দিন বিসর্জনের সুতোকাটার আগে এই লক্ষ্মী দেবীকে মন্দিরের বারান্দায় রাখা হয়। একে লক্ষ্মীনারায়ন মন্দির বারান্দা বলে। এরপর প্রত্যেক সেবাইত মাথায় করে নিজের নিজের বাড়িতে লক্ষ্মী দেবীকে নিয়ে যায়। এই সময় বাড়ির মহিলারা শঙ্খধ্বনি করেন। ও জলধারা দেন। নবমীর দিন কুমারী পুজো হয়। তবে এই পুজোয় একজন কুমারী নয় প্রত্যেক সেবাইতের বাড়ি থেকে আলাদা আলাদা করে কুমারী আসে। এদের পুজো করা হয়না , তাদেরকে বসিয়ে যত্ন করে খাওয়ানো হয়। দশমীর দিন প্রত্যেক সেবাইতের বাড়িতে অস্ত্র পুজো হয়। প্রতিমা বিসর্জনের পর পুরোহিত প্রত্যেক সেবাইতের বাড়ি গিয়ে আশীর্বাদ করেন। আগে এই প্রথার নাম ছিল জয়যাত্রা,  এখন বলা হয় আশীর্বাদ।

%d bloggers like this: