নবপত্রিকা

দুর্গাপুজোয় অতি প্রয়োজনীয় নবপত্রিকা, যা কিনা সাধারণের কাছে বেশি পরিচিত কলাবউ নামে। এই নবপত্রিকা আসলে কী? কেন দুর্গা পুজোয় ব্যবহার নবপত্রিকার  সেই বিষয়ে আলোকপাত করলেন কিশলয় মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপুজোর সপ্তমীর সকালে খুবই পরিচিত দৃশ্য হল নবপত্রিকা, আমরা দেখি একটি কলা গাছকে স্নান করানোর পর কাপড় পড়িয়ে গণেশ দেবের পাশে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। তাই অনেকে গণেশের বউ বলে আবার অনেকে বলে কলা বউ। রাধারমন রায় কলকাতার বিচিত্রা বইতে লিখেছেন শরৎকালে হতো নব পত্রিকা পুজো আর বসন্তকালে হতো দুর্গাপুজো। বসন্তকালের দুর্গাপুজোকে শরৎকালে নিয়ে এসে নবপত্রিকা পুজোর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। এই কাজ করেছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র ও কলকাতার নবকৃষ্ণ। আর তাঁদের উৎসাহিত করেছিল ক্লাইভ। এদিকে হুগলি জেলার গুড়াপে চট্টোপাধ্যায়দের বুড়িমা দুর্গাপুজো ও নাগ বাড়ির দুর্গাপুজোয় দেবী দুর্গার ডান দিকে থাকে কার্তিক আর বাঁদিকে থাকেন গণেশ। কিন্তু কলাবউ নিয়ম অনুসারে ডান দিকে বিরাজমান। সুতরাং কার্তিক দেবের পাশে নবপত্রিকা।

কৃত্তিবাসী রামায়ণে লেখা আছে “আচারেতে আরতি করিলা অধিবাস।/ বাঁধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।।” নবপত্রিকা অর্থাৎ ৯টি গাছ রয়েছে এখানে। শ্লোক অনুযায়ী পর পর রয়েছে কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মান ও ধান গাছ। এই ৯টি উদ্ভিদের পুজো হয়। প্রথমে নবপত্রিকাকে ৯ রকম পবিত্র জলে স্নান করিয়ে অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে কাপড় পড়িয়ে দুর্গার প্রতিনিধি হিসেবে পৃথক পৃথক মন্ত্রে পুজো করা হয়। হুগলি জেলার হরিপালে রায় বাড়ির দুর্গাপুজোয় প্রতিপদ, চতুর্থী ও ষষ্ঠীর দিন তিনটি নবপত্রিকা পুজো করা হয়। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রথম দুটি থাকে বোধন ঘরে।

নবপত্রিকাকে প্রথম শাঁখের জলে স্নান করানো হয় তারপর শাস্ত্রে ৯টি গাছকে ৯ রকম জলে স্নান করানোর কথা বলা হয়েছে। যেমন ক) কলা গাছকে ইষৎ গরম জলে, খ) কচু গাছকে কুপ বা কুয়োর জলে, গ) হলুদ গাছকে শিশির জলে, ঘ) জয়ন্তী গাছকে পুষ্পোদক জলে, ঙ) বেল গাছকে সর্বোষধি জলে, চ) ডালিম গাছকে সমুদ্র জলে, ছ) অশোক গাছকে সুগন্ধি জলে, জ) মান গাছকে রত্নোদক জলে, ঝ) ধান গাছকে তৈলদোক জলে। খুব সত্যি কথা বলতে  এই নিয়ম এখন খুব একটা মানা হয়না। যারা পারে করেন। হুগলি জেলার চণ্ডীতলার অন্তর্গত বোরিজহাটির মেজ মহাশয় বাড়ি বা চৌধুরি বাড়ির পুজোয় নবপত্রিকাকে সরস্বতী নদীতে স্নান করিয়ে শিশির জল, বৃষ্টির জল, গরম জল, পদ্ম জলে স্নান করানো হয়।

নবপত্রিকায় ৯ জন দেবী দুর্গারই রূপ তবে নবপত্রিকা ও নবদুর্গা আলাদা। নবপত্রিকায় ১) কলা গাছের অধিষ্ঠিতা দেবী হলেন ব্রহ্মাণী। দেবী শান্তি প্রদান করেন। ২) কচু গাছের অধিষ্ঠিতা দেবী হলেন কালিকা। দেবী সর্বসিদ্ধি প্রদায়িনী। ৩) হলুদ গাছের অধিষ্ঠিতা দেবী হলেন উমা। দেবী শান্তি প্রদান করেন আর বাধাবিঘ্ন নাশ করেন। ৪) জয়ন্তী গাছের অধিষ্ঠিতা দেবী হলেন কার্তিকী। দেবী ভক্তের জয়লাভের জন্য বর প্রদান করেন। ৫) বেল গাছের অধিষ্ঠিতা দেবী হলেন শিবা। দেবী সৌন্দর্য ও বিজয় বর্ধনকারী। ৬) ডালিম গাছের অধিষ্ঠিতা দেবী হলেন রক্তদন্তিকা। ডালিম বিজের মতো লাল দেবীর দন্ত পংক্তি। দেবী পাপ বিনাশ করেন আর ক্ষুদা নিবৃত্তি করেন। ৭) অশোক গাছের অধিষ্ঠিতা দেবী হলেন শোকরহিতা। দেবী ভক্তদের সমস্ত শোক দূর করেন। ৮) মান গাছের অধিষ্ঠিতা দেবী হলেন চামুণ্ডা। শত্রুনাশ করেন আর সকলের কল্যাণ করেন। ৯) ধান গাছের অধিষ্ঠিতা দেবী হলেন লক্ষ্মী। জগতের প্রাণ রক্ষা করেন। এদিকে হুগলি জেলার ভাস্তাড়ায় সিংহ বাড়ির পুজোয় পঞ্চমীর দিন দুটো নবপত্রিকা তৈরি  করা হয়। একটি থাকে বোধন ঘরে। অপরটি সপ্তমীর দিন পদ্মপুকুরে স্নান করিয়ে দুর্গার পাশে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। আর নবদুর্গা হলেন শৈলপুত্রি, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘন্টা, কুষ্মান্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যয়ণী, কালরাত্রী, মহাগৌরি ও সিদ্ধিদাত্রী।

কলাবউ গনেশ দেবের স্ত্রী নন। গণেশের স্ত্রী ঋদ্ধি ও সিদ্ধি। আর কলাবউ ধারনাটি একদমই বাঙালি। আসলে আমাদের দুর্গাপুজোয় দেবী দুর্গা তাঁর পরিবারকে নিয়ে কটাদিন আসে বাবার বাড়িতে। তাই দুর্গা আমাদের জননী আবার কন্যাও। বাবার বাড়িতে পুজোর কটা দিন ছেলে মেয়ে বৌমা এদেরকে নিয়ে ঘুরে যায়। নবপত্রিকা সাজ বিবাহিত বউ এর মতো। গণেশের পাশে থাকে বলে নবপত্রিকা হয়ে গেছে গণেশের বউ। এ পুরোপুরি বাঙালিয়ানা ধারণা।

তথ্য সূত্র : (ক) কলকাতার বিচিত্রা– রাধারমণ রায় (খ) কৃত্তিবাসী রামায়ণ (গ) দেব দেবীর কথা ও কাহিনী- সুধীর কুমার মিত্র (ঘ) নবদুর্গা- গীতাপ্রেস।

%d bloggers like this: