আমাদের মহাকাব্য, পুরাণ এর সঙ্গে দেবী মহামায়ার সম্পর্ক কী? রামায়ণ-মহাভারতের সঙ্গে দেবী মহামায়ার পুজোর বিষয়ে কী জানতে পারা যায়। সেই নিয়েই আলোকপাত করলেন কিশলয় মুখোপাধ্যায়
রামায়ণে যুদ্ধক্ষেত্রে রাবণ বিমর্ষ হয়ে দুর্গাস্তব করছেন।
“এই রূপে স্তব যদি করিল রাবণ।
আর্দ্র হৈল হৈমবতী মন উচাটন।।
স্তবে তুষ্টা হয়ে মাতা দিল দরশন।”
কৃত্তিবাসী রামায়ণ, এখানে দুর্গাপুজো বা এই শরৎকালে রাম কর্তৃক দুর্গাপুজোর সুন্দর ব্যাখ্যা আছে। সীতা উদ্ধারের জন্য রাম অকালবোধন দুর্গাপুজো করেছিলেন কিন্তু বাল্মীকি রামায়ণে দুর্গাপুজোর কোন উল্লেখ নেই। আবার সন্ত তুলসীদাসের রামচরিতমানস গ্রন্থে দেখা যায় সীতা রামকে স্বামী রূপে পাওয়ার জন্য দুর্গা দেবীর আরাধনা করেছিলেন। আর মহাভারতেও দুর্গাপুজোর উল্লেখ আছে দুবার। কালিকা পুরানে ব্রহ্মা দুর্গাপুজো করেছিলেন। শ্রীমৎদেবীভগবতম পুরাণে ঋষি নারদ রামকে নবরাত্রি ব্রতের কথা বলেছিলেন। আর এখানেই দেবী দুর্গা রামকে বসন্তকালেও পুজো করার কথা বলেছিলেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণে রাবণকে দেবী দুর্গা দেখা দিয়ে বললেন তিনি রাবণের পাশে থাকবেন।
“ভয় নাই ভয় নাই রাজা দশানন।
আসিয়াছি আমি আর কারে কর ডর।।”
এদিকে রাম যখন যুদ্ধক্ষেত্রে এলেন তখন দেখলেন রাবণের রথে স্বয়ং দেবী দুর্গা।
“আগুসরি যুদ্ধে এল রাম রঘুপতি।
দেখিলেন রাবণের রথে হৈমবতী।
বিস্মিত হইয়া রাম ফেলি ধনুর্বাণ।
প্রণাম করিল তাঁরে করি মাতৃজ্ঞান।।”
রাম তীর ধনুক রেখে যুদ্ধ না করার সিদ্ধান্ত নিলেন। যে রথে স্বয়ং দেবী দুর্গা সেখানে কিসের যুদ্ধ। সীতা উদ্ধার আর হলোনা। রাম বিমর্ষ ও ক্রন্দনরত। এই সময় ইন্দ্রদেব ব্রহ্মাকে বললেন রামের দুঃখতো আর দেখা যাচ্ছেনা যে।
“ইন্দ্ররাজা বিধাতারে সবিনয় কয়।
শ্রীরামের দুঃখ প্রাণে না সয়।।”
এরপর ব্রহ্মা রামকে দুর্গাপুজো করতে বললেন। রাম সাগর তীরে পুজোর প্রস্তুতি শুরু করলেন।
“প্রভাত হইল নিশা, প্রকাশ পাইলা দিশা,
স্নানদান করিলা শ্রীরাম।।
বন-পুষ্প-ফল-মূলে, গিয়া সাগরের কূলে,
কল্প কৈলা বিধির বিধান।
পুজি দুর্গা রঘুপতি, করিলেন স্তুতি-নতি,
বিরচিল চণ্ডী-পূজা গান।।”
অনেকেরই জানা কালিকা পুরাণ হল দেবী দুর্গাকে নিয়ে লেখা। অনেক পুজো এই মতে হয়। এখানে ব্রহ্মার উল্লেখ আছে। লঙ্কার যুদ্ধে ব্রহ্মা দেবী দুর্গার অকাল বোধন দুর্গাপুজো করেছিলেন। এবং তাই রাম রাবণকে হারাতে পেরেছিলেন। কিন্তু রামচন্দ্র দুর্গাপুজো করেননি। পাণ্ডবরা বারো বছর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে কামাখ্যায় পৌঁছালেন। এখানে যুধিষ্ঠির দু্র্গাস্তব করলেন। বেদব্যাস রচিত মহাভগবত পুরাণে লেখা রয়েছে যুধষ্ঠির বলছেন “হে বিশ্ব জননি তোমার পূজা কটাক্ষে আমরা শতরাজ্য প্রাপ্ত হই।” দেবী ভগবতী বলেছিলেন তোমাদের সমস্যা সমাধান হবে। এই সময় যুধিষ্ঠির পুনরায় স্তব করেন।
“নমস্তে পরমেশানি সনাতনী।
সুরাসুর জগদ্ধন্দ্য কামরূপ নিবাসীনি….”
এই স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী মহামায়া বর প্রার্থনা করতে বললেন। এই সময় যুধিষ্ঠির অজ্ঞাতবাসের কথা বললে দেবী দুর্গা বিরাট রাজ্যর কথা বলেন আর তাঁরা জয়লাভ করবেন বলে বর দেন। এরপর অর্জুন দুর্গাস্তব করেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়। যুদ্ধের ঠিক আগে শ্রীকৃষ্ণ যখন গীতা শুনিয়েছিলেন তার আগে যুদ্ধ জয়ের জন্য দেবী দুর্গার স্তব করতে বলেন। অর্জুন বলছেন, “হে জননী, তুমি যোগ সিদ্ধাকারী। তুমি সর্বরূপসমন্বয়স্তুতা, তুমিই কপিলা তুমিই কালী…. আমি পবিত্র মনে তোমার স্তব করি।” অর্জুনের স্তবে দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তৃতীয় পাণ্ডবকে বললেন, “তুমি শত্রুগণকে জয় করবে।” তবে বেদব্যাসের মহাভগবৎ গ্রন্থে শুধু অর্জুন নয় বাকি চার ভাই অর্থাৎ পঞ্চপাণ্ডব এক সঙ্গে স্তুতি করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে। এই বইতেই ১০৮টি নীল পদ্মের কথা উল্লেখ আছে।
“জয় গজানন আর ষড়ানন মাতা
জগত-জননী সৌদামিনী কান্তিযুতা”।
ভবানী ভবনে প্রবেশ করে সীতা দেবী দুর্গাকে প্রণাম করেন। তুলসীদাস রামচরিতমানস গ্রন্থে এরপর সীতা বলছেন
“মনোরথ ভালেরূপে জানহ আমার
হৃদয় পুরেতে সদা বৈস সবাকার
সে কারণে আমি ইহা প্রকট না করি
এত বলি নমে পদে জানকী কুমারী।”
দেবী দুর্গা বললেন
“শুনহ জানকি! সত্য আশীষ আমার
পুরিবেক মনস্কাম অবশ্য তোমার।”
বেদান্ত শাস্ত্রী শ্রী রাধিকা প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গানুবাদ বই থেকে উল্লেখ করা হল। শ্রীমৎদেবীভাগবৎ পুরাণ গ্রন্থে ঋষি নারদ রামকে নবরাত্রি ব্রতের কথা বলেছিলেন।
“উপানয়ং কথায়াম্যদ্য তম্য নাশায় রাঘব !
ব্রতং কুরস্ব শ্রদ্ধাবানাশ্বিনে মাসি সাম্প্রতম ।।
নবরাত্রো পবাসন্তে ভগ্যবত্যা প্রপূজনম
সর্বসিদ্ধি করং রাম!জগহোমবিধানতঃ”
অর্থাৎ রঘুনন্দন এখন তোমাকে রাবণের নিধন উপায় বলছি শ্রবণ কর। আপনি শ্রদ্ধাবান হয়ে এই আশ্বিনে মাসেই ব্রত অনুষ্ঠান করুন। নবরাত্রি উপবাস করে ভগবতীর পুজো ও বিধি ও জপ হোম অনুষ্ঠান করলে সব সিদ্ধি কামনাই পূরণ হয় এতে সন্দেহ নেই। রাম লক্ষণ দুজনে এই ব্রত পালন করলে অষ্টমীর দিন রাতে অর্থাৎ সন্ধিক্ষনে দেবী ভগবতী পুজোয় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী দেখা দিলেন। রাম দেখলেন পশুরাজ সিংহের ওপর বিরজামান দেবী মহামায়া। দেবী বললেন তুমি জয় করবে আর রাবণকে সংহার করে বসন্তকালে শ্রদ্ধার সঙ্গে আমার পুজো করে যথা সুখে রাজত্ব করতে থাকবে।
“বসন্ত সেবনং কার্য্যং ত্বয়া তত্রাতিশ্রদ্বয়া
হত্বাথ রাবণং পাপং কুরু রাজ্যং যথাসুখম।”
এই পুজোয় ঋষি নারদ হয়েছিলেন আচার্য্য। আমরা পুনরায় ফিরে যাই কৃত্তিবাসী রামায়ণে। রাম পুজো করলেও কোন লাভ হচ্ছেনা। তখন বিভিষণ ১০৮ টি নীলপদ্মের কথা বললেন।
“এক কর্ম কর প্রভু! নিস্তার কারণ।
তুষিতে চণ্ডীরে এই করহ বিধান।
অষ্টোত্তরশত নীলোৎপল কর দান।।”
এর আগে পঙতিতে বিভিন্ন ফুল দিয়ে রাম পুজো করছেন তা অতুলনীয় লিখেছেন কৃত্তিবাস। মূল সংস্কৃতি রামায়ণে রাম কর্তৃক দুর্গাপুজোর উল্লেখ নেই। সম্ভবত কৃত্তিবাস মহভগবৎ পুরাণ, দেবীভাগবৎ পুরাণ, কালিকা পুরাণ প্রভৃতি পুরাণ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তিনি রামায়ণে এই পুজো বর্ণনা করেন। এরপর সবাই অবগত আছেন দেবী দুর্গা পরীক্ষা করার জন্য একটি পদ্ম লুকিয়ে রেখেছিলেন। রাম একটি চোখ নিবেদনে উদ্যত হলে দেবী স্বয়ং তাঁকে নিরস্ত করেন। এবং বলেন–
“অকালবোধনে পূজা, কৈলে তুমি দশভূজা
বিধিমত করিলা বিন্যাস।
লোক জানাবার জন্য, আমারে করিতে ধন্য,
অবনীতে করিলা প্রকাশ।।
রাবণে ছাড়িনু আমি, বিনাশ করহ তুমি,
এত বলি হৈল অন্তর্দ্ধান।”
এরপর রাবণ হতে ভগবতী ত্যাগের জন্য হনুমান কর্তৃক চণ্ডী অশুদ্ধ হয়। আর তারপর হয় রাবণ বধ।
শরৎকালের দুর্গাপুজো আমাদের বাঙালির কাছে শ্রেষ্ঠ উৎসব বলা যায়। আর বাংলা ভাষায় রামায়ণে কৃত্তিবাস সুন্দর বর্ণনা করেছেন। এই পুজোর আবাহনে কৃত্তিবাসী রামায়ণের এই অধ্যায় বার বার পড়লেও কোনও বিরক্তি লাগেনা। এর এমনই অমোঘ আকর্ষণ।