কলকাতা ছাড়িয়ে বনেদি বাড়ির পুজোর সুলুক সন্ধান

আমাদের এই বাংলার নানান প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে নানা প্রাচীন বনেদি বাড়ির ঐতিহাসিক দেবী আরাধনার ইতিহাস। আজ থেকে সংবাদ প্রতিখন আপনাদের জন্য নিয়ে আসছে সেই সকল বনেদি বাড়িগুলির দুর্গাপুজোর ইতিহাস।  আজ তৃতীয় পর্বে লিখছেন অভিজিৎ হাজরা

শতাব্দী প্রাচীন রায় পরিবারের দুর্গোৎসবে মায়ের চামুণ্ডা মূর্তি

অমরাগড়ী রায় পরিবার ট্রাস্টের সম্পাদক সৌরভ রায় বলেন, ” তাঁদের দুর্গাপুজো সম্পর্কে বলার আগে তাঁদের পরিবারের ট্রাস্টের সম্পর্কে জানা দরকার। এটি গঠিত হয়েছিল বাংলার ১১২৬ সালের ১৫ বৈশাখ। বতর্মানে ৩০৪ বছরে পদার্পণ করেছে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্বর্গীয় শান্তি রায়। শান্তি রায় ছিলেন একজন ব্যবসায়ী এবং এর জন্য তিনি দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেন। এই রকম একদিন তিনি বাণিজ্য করতে বেরিয়ে বতর্মানে হাওড়া জেলার আমতা বিধানসভা তথা আমতা ২ পঞ্চায়েত সমিতির অন্তর্গত অমড়াগড়ী গ্ৰামে রাত্রীযাপনের জন্য নৌবহর বাঁধেন। সেই রাত্রে মা গজলক্ষী দেবী স্বর্গীয় শান্তি রায়কে স্বপ্নাদেশ দেন, ” তুই আমাকে ছেড়ে যাস না, আমার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা”।

সেই শুনে তিনি শ্রী গজলক্ষী মাতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই গ্ৰামে বসবাস করতে শুরু করেন। গড়ে তোলেন শ্রী শ্রী গজলক্ষী মাতা এস্টেট। তিনি বাইরে থেকে সমস্ত সম্প্রদায়কে এনে এই গ্ৰামে বসবাস করান এবং এই গ্ৰামটিকে আদর্শ গ্ৰামে রুপান্তরিত করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এই স্টেট একই ভাবে চলে আসছে। এই এস্টেটের বিভিন্ন পূর্জাচ্চনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য রথ যাত্রা, জম্মাষ্টমী, রাস যাত্রা,  চৈত্র সংক্রান্তি, ১ লা বৈশাখ,  ঝাঁপ ও গাজন,  শিবরাত্রি পূজা, চাঁচড় ও দোল, মকর সংক্রান্তি, দশোহারা এছাড়া নিত্যসেবা শ্রী শ্রী গজলক্ষী দেবী ও তিনটি শিব মন্দিরের পুজা এখনও চলে আসছে। সেই সঙ্গে বাঙালীর মহাপুজা দুর্গা পূজা ও চলে আসছে। এই বছর এই পরিবারের দুর্গা পূজা ৩০৪ তম বর্ষে পদার্পণ করেছে।

এই পরিবারের মাতৃপুজার বৈশিষ্ট্য একচালা প্রতিমা ও চামুণ্ডা মূর্তি। মহালয়ার পরের দিন অর্থাৎ প্রতিপদ থেকে শুরু হয় চন্ডীপাঠ। নিত্যদিনের সন্ধ্যারতির মাধ্যমে প্রতিপদের দিন থেকে রায় পরিবারের দুর্গোৎসব পূর্ণ মাত্রা নেয়। কথিত আছে ১৮৫ বছর আগে মোষ বলি হত। বতর্মানে বলি বন্ধ। কারণ হিসাবে জানা যায়,  ১৮৫ বছর আগে এই এলাকা জলাজঙ্গলে ভরা ছিল। শোনা যায়,  সন্ধিপুজোর সময় কামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিল রাত্রে। রাস্তায় কামারকে বাঘে ঘেরে। ভয় পেয়ে কামার একটি গাছের উপর উঠে বসে।

এদিকে সন্ধিপূজার বলির সময় আসন্ন। যখন সন্ধিপূজার ঘন্টা পড়ছে তখন ও বাঘ গাছের নীচে বসে। তখন কামার মায়ের নাম স্মরণ করে বাঘের উপর পড়ে। কামারের হাতে থাকা বলির কাতানের কোপে বাঘের মুন্ডুচ্ছেদ হয় ও সন্ধিপূজার বলির সমাপন ঘটে। সেই রাত্রে দেবীর স্বপ্নাদেশ হয়, ” কিরে আমার বাহনকে মেরে ফেললি?  তোরা বলি বন্ধ কর”। সেই থেকে বলি বন্ধ।

পুজোর নবমীর দিন সন্ধ্যাবেলায় লুচি ভোগ বিতরণ করা হয়। এছাড়া পঞ্চমীর দিন বাড়ির মেয়েরা, বউরা নারকেল নাড়ু তৈরি করেন। আর একটি বৈশিষ্ট্য এই পরিবারের ঠাকুর দশমীর দিন দুপুর ১২ টার পর বিসর্জন হয়। এর কারণ ১৫৫ বছর আগে এই পরিবারের এক সদস্য দুপুর ১২ টার সময় মারা যান। সেই থেকেই দুর্গা ঠাকুর বিসর্জন দুপুর ১২ টার পর থেকেই হয়ে আসছে। এই বিসর্জন হয় পাশের প্রতিষ্ঠা করা রথ পুকুরে। গ্ৰামের একটিই পুজা,  কিন্তু বর্তমানে এটি রায় পরিবারের পুজার মধ্যেও সীমাবদ্ধ নেই। গ্ৰামের সবাই এসে এই পুজায় ভিড় জমায়।

বতর্মানে বাজারের জিনিষপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় পুজার জৌলুস কিছুটা কমেছে। যাই হোক বিভিন্ন জেলার মতোই আমাদের এই প্রাচীন দুর্গোৎসব আজ ও বয়ে চলেছে চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী।

%d bloggers like this: