এক পর্বের গল্প – মরীচিকা

সংবাদ প্রতিখনের সাহিত্যের পাতায় গল্প নিয়ে উপস্থিত  প্রতিবেশী  দেশ বাংলাদেশের ঢাকা থেকে লেখিকা নাজনীন রাহমান

মরীচিকা

খাটের ওপর বসে বার্ষিক পরীক্ষার খাতা দেখছিলো বেনু, মা নাসিমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বুঝলো আর কাজ করা যাবে না, এখনি একটা বিষয় নিয়ে কথা বলে উত্তেজিত হয়ে উঠবেন তিনি,  অবশ‍্য ব‍্যাপারটার কোনো গুরুত্ব নেই বেনুর কাছে,  তবু মায়ের আকুল একান্ত ইচ্ছার বিরোধিতা  করে তাঁর মনে কষ্ট দিতে চায় না সে।

ছড়িয়ে থাকা খাতাপত্র একটু সরিয়ে মাকে বললো, বসো মা, খাবার আগে যে ওষুধটা খাওয়ার কথা, খেয়েছো সেটা?

মাকে মাথা নাড়তে দেখে একটু বিরক্তির সুরে বললো বেনু, কি যে করো মা, নিজের দিকে কোনো খেয়ালই থাকে না তোমার, বসো, নিয়ে আসছি ওষুধটা।

খাট থেকে নামতে উদ‍্যত হয় বেনু,  মেয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসলেন নাসিমা তারপর মৃদু অথচ দৃঢ় কন্ঠে বললেন, তোকে ব‍্যস্ত হতে হবে না, বোস স্থির হয়ে, শুধু ওষুধ খেলেই আমি সুস্থ থাকবো তাই না? আমার শান্তি কিসে তুই জানিস না?

বেনু হাসার চেষ্টা করে বলে, মা, ওষুধের সঙ্গে শান্তির কি সম্পর্ক! ও তোমার ওষুধ না খাবার বাহানা।

মা চুপ করে রইলেন খানিকক্ষণ তারপর বিষন্ন সুরে বললেন, তাহলে কি বলবো তোর মামাকে? প্রশ্ন করে উদগ্রীব হয়ে চেয়ে থাকলেন বেনুর মুখের দিকে, জবাব কি হবে জানেন তিনি, তবু আশা মেয়ে যদি তাঁর দিকে চেয়েও রাজী হয়।

বেনুর মুখে বেদনার ছায়া এক পলক ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেলো, মাথা নীচু করে আস্তে বললো, আমি কি বলবো, স্কুলে এখন ভীষণ কাজের চাপ, আমার সময়  —

অস্থির নাসিমা বাঁধা দিয়ে বললেন, ওসব তোর অজুহাত, চাকরি করলে বিয়ে করা যায় না? তোর মামা এত ভালো ছেলের সন্ধান আনলেন, বিয়েতে তুই রাজী হবি না জানতাম, তবু ভাবলাম আমার কথা মনে করেও অন্তত। কান্নায় কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো তাঁর।

ব‍্যাকুল হয়ে মা’র হাত চেপে ধরলো বেনু, মা, মা শোনো মা, তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না, সেটা তো জানো, কিন্তু আমি, আমিও যে কোনো ভাবেই, বেনুও আর কিছু বলতে পারলো না, বুক ফেঁটে কান্না আসছে তারও।

জানি আমি সব জানি, বুঝি, তবে এভাবে আর কতদিন, আমি কি চিরকাল থাকবো? তোর একটা ব‍্যবস্থা না হলে মরেও যে আমি শান্তি পাবো না।

মা, এভাবে বোলো না, বিয়ে না করেও একটা মেয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে, যদি সে ভালো ভাবে স্বাবলম্বী হয়।

তোর এসব কথা অনেক শুনেছি, তোর যা মন চায় তাই কর, আমি আর কিছু বলবো না। বেনু বাঁধা দেবার আগেই খাট থেকে নেমে চোখ মুছতে মুছতে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন নাসিমা।

বেদনায় হ্নদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো বেনুর, একবার ভাবলো উঠে যেয়ে মাকে ফিরিয়ে এনে বলে। মা, তুমি যা চাইছো তাই হবে, তোমার অবাধ‍্য হবো না। কিন্তু অনিচ্ছুক মন সায় দিলো না, কি হবে মাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে। ওর পক্ষে কিছুতেই বিয়ে করা সম্ভব নয়। আজ কতদিন ধরে আত্মীয়স্বজন ওর বিয়ের জন্য ভালো ভালো প্রস্তাব নিয়ে আসছেন কিন্তু বেনুর বিষিয়ে যাওয়া বিষাক্ত মন কিছুতেই রাজী নয়, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা তার। কোনো পুরুষের ছায়াও তার জীবনে পড়তে দেবে না, বিয়ে তো আরো দুরের কথা।

বেনুর দুই মামা, বড় মামার কাছেই ওরা থাকে। একমাত্র ছোট বোন নাসিমার জীবনে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত মর্মান্তিক বিপর্যয়ের পর নিজের কাছেই এনে রেখেছেন মামা, তাও প্রায় পনেরো বছর হয়ে এলো। মামাদের অবস্থা ভালো। ছোট মামা চাকরি সূত্রে দেশের বাইরে থাকেন, তবু তিনিও বোন ভাগনীর যথেষ্ট খেয়াল রাখেন। বড় মামা-মামী ওদের খুবই আদর যত্ন করেন, নিজ সন্তানের মতই বেনুকে স্নেহ মমতা করেন, মামাতো ভাই বোনেরাও সহানুভূতিশীল, বেনুদের কোনো রকম অযত্ন, অনাদর হয়নি।

এম. এ. পাশ করে ভালো সরকারি স্কুলে চাকরি করছে বেনু। মামারা চাকরি করতে মানা করেন নি কারণ একটা কিছু নিয়ে ভুলে থাকবে মেয়েটা, এটা চেয়েছেন তাঁরা। বোন-ভাগ্নীর যন্ত্রণার কথা ওনারা তো ভালো করেই জানেন। সুন্দরী, শিক্ষিতা মেয়ের পাত্রের অভাব হয় না। এর সঙ্গে যদি বিত্তের জৌলুস থাকে তো সোনায় সোহাগা। তথাপি যে বিষাক্ত কাঁটা বিঁধে আছে বেনুর অন্তরে, সেটা সমূলে উপড়ে ফেলার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিক্ত দুর্বিষহ অতীত ভুলে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা ওর পক্ষে সহজ হবে না।

অনেক ভেবেছে বেনু। সব মানুষ এক হয় না, ব‍্যতিক্রম অবশ্যই আছে। বিয়ে হলে হয়তো সুখী হবে সে। আর যদি না হয়, তবে? এই তবের দ্বন্দ্বে পড়ে সে এই সিদ্ধান্ত নেয়নি। শৈশবে কোনো কিছু ভালো করে বুঝতে পারার আগেই যে বিভীষিকার মধ্যে দিন কেটেছে তার, সে কারণেই অবচেতন মনে ভালো ভাবেই গেঁথে গেছে এক আতঙ্ক। পরবর্তীতে সেটাই বিষাক্ত বিষ হয়ে ওর দেহ মন আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং স্থির করেছে। কোনো দিন সে বিয়ে করবে না।

বেনুর বাবা কোহিনুর। আশ্চর্য সুন্দর রূপবান একজন পুরুষ। কিন্তু সাচ্চা হীরার চমক নয়, জৌলুসহীন, মূল‍্যহীন নকল এক হীরা। বিদ‍্যা, বিত্ত সবই ছিলো এই পুরুষের, শুধু ছিলো না চারিত্রিক সংযম।

রূপসী নাসিমাকে সে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলো কিন্তু এক নারীতে সন্তষ্ট থাকার বান্দা সে নয়, স্ত্রীর প্রতি বেশিদিন নিজের বিশ্বস্ততা, সততা ধরে রাখতে পারেনি। দুর্দান্ত দুশ্চরিত্র কোহিনুরকে চিনতে ভুল করার মাশুল নাসিমা দিয়েছে। মদ, অন‍্য নারীতে তীব্র আসক্ত কোহিনুর স্ত্রীকে অহেতুক পীড়ন করেও আনন্দ পেতো, তার বিকৃত লালসা, সুখী সুন্দর, স্বাভাবিক সংসার গড়ে তোলায় মস্ত বাঁধা ছিলো। বিয়ের আগে কত মিষ্টি কথা, মধুর ব‍্যবহার। পরে সেই মানুষটাই আমূল বদলে গেলো। রূপসী নাসিমাকে বিয়ে না করলে পাওয়া সম্ভব ছিলো না, তাই সে ছলনায় ভুলিয়েছিলো সহজ সরল মেয়েটিকে, নাসিমা তার প্রেমিকের স্বরূপ বুঝতে পারেনি। কাজের মেয়ে থেকে শুরু করে কলর্গাল, নিম্ন শ্রেণীর বেশ‍্যা ইত্যাদি কোনোটাতেই তার অরুচি ছিলো না, সাথে মদের নেশা তো ছিলোই।

সময়-অসময় নেই, এক রাশ বন্ধু-বান্ধব বাড়িতে এনে উপস্থিত করতো এবং নাসিমাকে চোদ্দ পদের রান্না করে খাওয়াতে হোতো তাদের। লন্ডীর ইস্ত্রী করা কাপড় পছন্দ নয় তার। নাসিমাকেই ইস্ত্রী করে দিতে হোতো। বাচ্চা পেটে আসার পর চেক আপের জন্যও বিবেকহীন স্বামী গাড়িতে করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে রাজী হোতো না, কি যে কষ্ট  হোতো নাসিমার, কত অনুনয় করে বলেছে, ওগো রিকশার ঝাঁকুনিতে আমার বড় কষ্ট হয়, গাড়িতে করে নিয়ে যাবে?

নির্বিকার মুখে কোহিনুর জবাব দিয়েছে, আমার কাজ রয়েছে, সময় হবে না। রিকশায় মানুষ যাচ্ছে না? তুমি কোন নবাব নন্দিনী।

দাঁতে দাঁত চেপে সবই সয়েছে নাসিমা। কোনো সময় প্রতিবাদ করার সাহস ছিলো না ওর। কিছু বলতে গেলেই বিশ্রী গালাগালি করতো কোহিনুর। পরে মারধোরও শুরু করেছিলো। বিবাহিত জীবনটা নরকতুল‍্য হয়ে উঠেছিলো নাসিমার। এই নরকের মধ্যেই ফুলের মত নিষ্পাপ শিশু বেনুর জন্ম।

অবুঝ শিশু দুচোখ মেলে দেখেছে বাবার ভয়াবহ তান্ডব আর মা’র অসহায় নিপীড়িত করুণ মুখ। বাবার আদর, স্নেহ কোনদিনও পায়নি বেনু। কাছে গেলেই কঠিন মুখ করে কোহিনুর ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে মেয়েকে। এরপর বুঝতে শেখার পর বেনু নিজেই আর বাবার কাছে যেতো না, নাসিমাও মেয়েকে আগলে রাখতো। বেনুর কোমল মনে বাবার বিবেকহীন আচরণ আতঙ্ক ও ঘৃণার ছাপ ফেলেছে। পুরুষের প্রতি বিরূপ ধারণা ও কঠোর মনোভাব নিয়ে সে বড় হয়েছে।

আপু, এত মনোযোগ দিয়ে কার কথা চিন্তা করছো! কে সেই ভাগ‍্যবান? চমকে ওঠে বেনু, এতক্ষণ কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলো সে, তিক্ত অতীত থেকে  মামাতো বোন শেলীর কথায় বর্তমানে ফিরে আসে, শেলী, এক বছরের ছোট ওর থেকে। সে শুধু বেনুর বোন নয়, প্রিয় বান্ধবীও। নানারকম গল্প, কথা হয় দুজনের। এখন শেলীর কথায় হাসে বেনু, নারে দুষ্টু মেয়ে, ভাবার মত তেমন কেউ নেই। ভুরু কুঁচকে শেলী বলে, তেমন কেউ! তার মানে কোথাও এক আধজন কেউ আছে? হেসে ফেলে বেনু, ফাজিল মেয়ে, বলছি তো কেউ  নেই।

ঠিক আছে, কেউ যদি নাই থাকবে, তাহলে বিয়েতে আপত্তি করো কেন?

শেলী জানে না যে বেনু পুরুষ বিদ্বেষী, কার জন্য মা-মেয়ের জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে, সেটাও সে ভালো মত জানে না, বুঝবেও না। শেলীর সহজ সরল স্বাভাবিক জীবনে কোনো রাহুর ছায়া পড়েনি তাই সে বেনুর অন্তর্জালা অনুধাবন করতে সক্ষম নয়। তাছাড়া নিজের বাপের কথা ছোট বোনের কাছে কি বলা যায়, তাই শেলীর এসব কথায়, এটা সেটা বলে এড়িয়ে যায় বেনু, প্রকৃত সত্য বলা সম্ভব নয়।

কদিন পরে আবার শেলী প্রসঙ্গ তোলে, আপুকে নিশ্চয়ই কেউ ভালোবাসে, এমন গুনবতী, রূপসীকে কেউ পছন্দ করেনি, তাই কি হয়!

শেলীর জ্বালাতনে উত‍্যক্ত হয়ে অবশেষে এক বুদ্ধি বের করে বেনু।

সেদিন শ্রাবনের অঝোর ধারা ঝরছে সারাদিন, বিকেলে বারান্দায় বসে মুড়ি মাখা সহযোগে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে দুই বোন দেখছে বৃষ্টির রিমঝিম, পথচারীর ভিজতে ভিজতে পথ চলা। শেলী চা শেষ করে দুষ্টু হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলে,  আপু তুমি কিন্তু গোপন করছো কোনো ব‍্যাপার।

প্রথমে বুঝতে পারে না বেনু তারপর হাসে, তোর মাথা থেকে পোকাটা বুঝি যায়নি? আচ্ছা বেশ বলছি, শোন তবে কিন্তু যা বলবো গোপন রাখবি, কাউকেই বলতে পারবি না, প্রতিজ্ঞা কর, নইলে কিন্তু বলবো না। পুলকিত শেলী রাজী হয়, মরে গেলেও কাউকে বলবে না। তখন বেনু কাল্পনিক এক কাহিনী শোনায়, একজন সত্যিই আছে তার হ্নদয়ের মনিকোঠায়, বর্তমানে সে বিদেশে কর্মরত, ছুটি পেলেই দেশে এসে মামাদের সাথে দেখা করে যা বলবার বলবে। শেলী সব শুনে খুব খুশী, মুখটা উজ্জল হয়ে ওঠে,  তাই বলো, কি চাপা মেয়ে, আর আমরা তো ভেবেই অস্থির, ঠিক আছে, প্রতিজ্ঞা যখন করেছি, কাউকে বলবো না, তুমি শুধু একটা কথা বলো, হবু দুলাভাইয়ের নাম কি এবং উনি দেখতে কেমন?

দুষ্টু মেয়ে, এত পাকা হয়েছিস, দুলাভাই বলছিস যে? আর এটা তোর শুধু একটা কথা হলো!

 বারে, তোমার বরকে তো আমি দুলাভাই’ই বলবো, না? বলো না আপু ওনার নাম কি?

নাম, নাম! আকাশ পাতাল চিন্তা করে বেনু ইস, একটা মিথ্যা শুরু করলে দশটা মিথ্যা বলতে হয়। এখন কাল্পনিক এই মানুষটার কি নাম দেওয়া যায়! ভাবতে ভাবতে চকিতে মনে পড়ে বেনুর, কিছু দিন আগে একটা কবিতার বইয়ে পড়া কয়েকটা লাইন, চমৎকার লেগেছিলো,

আকাশের নীল মিশেছে সাগরের নীলে কিন্তু গহীন পানিতে জন্মেছে

পান্না সবুজ শৈবাল–

হ‍্যাঁ ঠিক, শৈবাল, দ্বিতীয় বার চিন্তা না করে বেনু জানায়, ভদ্রলোকের নাম শৈবাল, আর দেখতে? বেনুর ভাবান্তর লক্ষ‍্য করেছিলো শেলী, বাঁধা দিয়ে অসহিষ্ণু কন্ঠে বলে, অনেক ভেবে নামটা বললে মনে হয়? দেখ আপু, সত্যি করে বলো, কেউ আছে তো? নাকি আমাকে ভুলাচ্ছো।

অবাক হবার ভাণ করে বেনু, সেকি! তোর বিশ্বাস হলো না? আচ্ছা কাজ আছে আমার, উঠি, তোকে আর কিচ্ছু শুনতে হবে না।

 না আপু রাগ কোরো না, মনে হোলো তুমি চিন্তা করে নামটা বললে তাই, খুব সুন্দর নাম, এখন বলো শৈবাল দুলাভাই দেখতে কেমন?

ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে বেনু, গম্ভীর মুখে সার্কাসের জোকারের মত বলেই চলে গেলো আর হাসতে হাসতে অস্থির হলো শেলী।

পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে আকাশে। গাঢ় নীল রঙের মধ্যে ঝলমলে সোনালী আভা, প্রকৃতিকে অসাধারণ সৌন্দর্যে অতুলনীয় করে তুলেছে। জানালার পাশেই বেনুর খাট। ওপাশের খাটে শেলী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুম আসছে না বেনুর। নিশীথ রাতের তারা ঝলমল আকাশে অসম্ভব সুন্দর চাঁদের পানে অপলক চেয়ে ভাবছে বেনু, কে শৈবাল! দেখতে কেমন! রূপকথার রাজপুত্রের মত? বেনুকে সে কতটা ভালোবাসত! সীমাহীন ভালোবাসার উদ্দাম ঘূর্ণিতে বেনুকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত কি? এমনই চাঁদনী রাতে প্রিয়তমার কানে কানে আবেগ বিহবল  কন্ঠে বলতো কি,  তোমাকে ভালোবাসি! না না, এসব কি ভাবছে সে, তার জীবনে কেউ আসবে না, সে আসতে দেবে না। পুরুষের ছায়াও থাকবে না ওর আশেপাশে।

তথাপি বেনুকে যেন কি এক নেশায় পেয়ে বসে, শেলীর পীড়াপীড়িতে আবার এক সন্ধ্যার আবছা আলোয় বসে তাকে বলতেই হয় যে তার প্রেমিক পুরুষ দেখতে কেমন। অন্তরের অবচেতনে কল্পনার যে দীপ্ত পুরুষের রূপ, ছবি আঁকা ছিলো বেনুর। সেটাই ভাষার সৌন্দর্যে অলংকৃত করে শেলীকে বললো, শৈবাল, দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ এক সুপুরুষ। বসন্তের মাতাল বাতাসে প্রেমিক পুরুষের কোঁকড়া ঘন কালো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে বেনুর মসৃণ গাল ছুঁয়ে শিহরিত করে তোলে প্রেয়সীকে। নিদাঘের দাবদাহে মুক্তার মত বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে পুরুষের প্রশস্ত ললাটে, ঘনঘোর বর্ষার ধারাপাতে সিক্ত, লোমশ পেশল কপাট বক্ষে পৌরুষের আন্তরিক হাতছানি, শরতের সাদা কাশফুলের শুভ্রতা সুগঠিত দাঁতের সারিতে, অপূর্ব মোহনীয় হাসিতে প্রেয়সীকে করেছে মুগ্ধ, হেমন্তের সোনালী শস‍্যের আশ্বাস রমণীর পরম ভরসা, শীতের শীতল প্রবাহে শক্ত কঠিন বাহুর উষ্ণতায় নারীর তনুতট সজীব, সতেজ। সবচেয়ে প্রানবন্ত শৈবালের চোখ দুটি। গভীর কালো মায়াবী দৃষ্টিতে কি যাদু, কবির ভাষায়, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।

শেলী মুগ্ধ হয়ে শোনে, বেনুর শৈবালকে যেন চোখের সামনেই দেখতে পায়। এমনই জীবন্ত বর্ণনা।

বেনুর নিষেধ সত্ত্বেও চুপিচুপি খানিকটা আভাস দিয়েছে শেলী ফুপুকে, ওনার বেদনা, মলিন, বিষন্ন চেহারা ওকে বড় কষ্ট দেয়। আপাকে নিয়ে ফুপুর চিন্তার কথা জানে। সময় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে, এই বলে শেলী সান্ত্বনা দিয়েছে।

আজকাল কেমন যেন অন‍্যমনস্ক হয়ে থাকে বেনু। কাজ কর্ম সবই করে কিন্তু ছাড়া ছাড়া ভাবে, কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারে না, নিজেকে প্রশ্ন করে বেনু। কি হয়েছে আমার? প্রেমে পড়েছি? কিন্তু কার প্রেমে? কেন শৈবালের?

শৈবাল, যার কোনো অস্তিত্ব পৃথিবীর কোথাও নেই। সে তো বেনুরই মনগড়া কল্পনার পুরুষ। বেনু স্বপ্নেও তাকে দেখেনি। বাবার ভয়াল রূপ ভুলতে পারা সম্ভব নয়। তাই কোনো স্বপ্নপুরুষকেও প্রশ্রয় দেয়া অসম্ভব।

শেলীর অস্থির তাগাদায় বিরক্ত বেনু বলে যে তার কোথাও কেউ নেই, সব কল্পনা, মিথ্যে। শেলী বিশ্বাস করে না। ভাবে  বোধহয় ওদের মধ্যে মনোমালিন‍্য হয়েছে তাই আপুর রাগ হয়েছে,সময়ে ঠিক হয়ে যাবে।

শেলী যা খুশী ভাবুক আর দুর্বলতা নয়। পুনরায় শক্ত কঠিন আবরণে নিজেকে ঢেকে ফেলে বেনু।

কদিন পরে, স্কুল শেষে বাসায় ঢুকতেই খাবারের সুঘ্রাণ পেলো বেনু, ঘিয়ের মনমাতানো সুগন্ধ বাতাসে ভেসে পুরো বাড়ি ভরে গেছে। হাসিমুখে রান্না ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো বেনু, মা মামী রান্না নিয়ে মহা ব‍্যস্ত।

 মা তোমরা কি রান্না করছো, সুন্দর খুশবু বেরিয়েছে।

ওর সাড়া পেয়ে মামী ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, বেনু এসেছিস মা, আয় আয়। জানিস আজকে-

বাঁধা দিয়ে নাসিমা বললেন, আগে হাতমুখ ধুয়ে নে আমি চা নিয়ে আসছি।

মামী একটু অবাক হয়ে মায়ের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বেনু আর কথা বাড়ালো না, কোনো কারণে মা’র মেজাজ খারাপ বুঝে ঘরে যেয়ে বাথরুমে ঢুকলো। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বেনু দেখলো মা চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

কি ব‍্যাপার মা, তোমার মন খারাপ, কি হয়েছে? অবশ‍্য যা রান্না হচ্ছে তাতে তো মনে হয় না খারাপ কিছু।

মা’র মুখ আগের মতই গম্ভীর, একটু চুপ করে থেকে বললেন,আজ শেলীর পানচিনি।

দারুণ চমকে উঠে আশ্চর্য হয়ে বললো বেনু, তাই নাকি, হঠাৎ! সকালে বের হওয়ার সময় তো কিছু শুনলাম না! চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শুনলো বেনু ঘটনা।

ছোট মামা যে ছেলের সাথে ওর সম্বন্ধ এনেছিলেন, তার সাথেই শেলীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। বর, মামার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছেলে, বেনু বিয়েতে রাজী না হওয়ায়, বন্ধুকে সরাসরি মানা করে দিতে পারেননি মামা, এতে তাঁর সম্মানের প্রশ্ন জড়িত। অতএব সবদিক ভেবে শেলীর সাথেই বিয়েটা ঠিক হয়েছে। পাত্র বিদেশে চাকরী করে, বিয়ে করতে দেশে এসেছে, ছুটি বেশী পায়নি তাই একরকম তাড়াহুড়ো করেই সব করতে হচ্ছে। বেনু বের হয়ে যাওয়ার পর পাত্রপক্ষ ফোন করেছিলো। আজকেই মেয়েকে আংটি পরাতে আসবে।

এতক্ষণে মা’র ব‍্যথাটা বুঝলো বেনু, মন খারাপের কারণ জেনে ওরও ভালো লাগলো না, মাকে বড় কষ্ট দিয়েছে সে, কত আশা করে ছিলেন। মা’র মনের অবস্থা বুঝে আর কোনো কথা বলতে সাহস করলো না বেনু। নাসিমা বিষন্ন ম্লান মুখে চুপচাপ খানিক বসে থেকে চলে গেলেন।

শেলীকে পিছন থেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে হেসে উঠলো বেনু। ওরে দুষ্টু মেয়ে, ছাদে এসে লুকিয়ে থাকা হয়েছিলো? ঘরে না পেয়েই বুঝেছি কোথায় পালিয়েছিস। লজ্জা রাঙা নত মুখে শেলী জড়িত স্বরে বললো,  আমার ইচ্ছে ছিলো না আপু, বাবা মা মামার জন্য, বিশেষ করে ফুপু বললেন বিয়েতে রাজী হয়ে যেতে। ওনাদের মনে ব‍্যথা দিতে চাইনি।

হয়েছে, আর কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমি খুব খুশী হয়েছি, আমার কথা তো জানিসই, একজনের জন্য অপেক্ষা করছি, এখানে তোর বিয়ে হলে আমরা সবাই বিশেষ করে মা খুব খুশী হবেন।

 জানি আপু, সেজন্যই,

তা, তোর বরের নামটা কি শুনি?

জানিনা যাও, বরের নাম বুঝি জিজ্ঞেস করা যায় ?

লজ্জায় মুখ নীচু করে হাসে শেলী। বেনু আর কিছু বলতে দিলো না ওকে। লজ্জাবতী কনে আর বাহানা করতে হবে না, চল চল, দেরী হয়ে যাচ্ছে, ওনারা শুনেছি সন্ধ্যার পরেই আসবেন, পার্লারে যেতে হবে না? বোনকে সস্নেহে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে নীচে নেমে এলো বেনু।

রাত নিশুতি। আকাশের দিকে চেয়ে শুয়ে আছে বেনু, ঘুমাতে পারছে না। ভাবছে, মাকে বড় কষ্ট দিয়েছে সে, হাসিমুখে মেহমান দারী করেছেন মা কিন্তু তাঁর বেদনা বেনুর কাছে চাপা দিতে পারেননি, স্বামীর কাছে সুখ পাননি। মেয়ে সহ স্ত্রীকে বের করে দিয়ে আর একটা বিয়ে করেছিলো কোহিনুর, মুখ বুজে অন‍্যায় অবিচার সয়েছেন, বিনা প্রতিবাদে মেয়েকে নিয়ে স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে এসেছেন, নিজেও যেমন অমানবিক ব‍্যবহারের কোনো প্রতিকার করতে চাননি তেমনি মামাদেরও স্বামীর বিরুদ্ধে কিছু করতে দেননি। ওর সেই দুখী মাকে এতটা যন্ত্রণা দেওয়া ঠিক হয়নি। অনুতপ্ত বেনু প্রতিজ্ঞা করে, শেলীর বিয়ের ঝামেলা শেষ হলে মাকে বলবে, মাগো, তোমার এই অবাধ‍্য মেয়ে আর তোমাকে দুঃখ দেবে না, তুমি যা বলবে আমি তাই করবো।

আশ্চর্য, এরপরেই দুচোখে ঘুম নেমে এলো বেনুর,  দীর্ঘদিনের দ্বিধা দ্বন্দের অবসান হওয়ায় শান্তির ঘুম ঘুমালো সে।

বিয়ে বাড়ি, আলোর মালায় সজ্জিত হয়ে ঝকমক করছে। বিভিন্ন মানুষের কলরোলে মুখরিত চারদিক, সুস্বাদু খাবারের সুগন্ধে বাতাস আমোদিত। শেলীর কাছে বসে একটুক্ষণ খুনসুটি করে সরে এলো বেনু, বধূবেশে শেলীকে কি অসাধারণ সুন্দর লাগছে, সব মেয়েকেই বোধহয় বিয়ের দিন এমনি লাগে, হয়তো ওকেও লাগতো। শৈবালের মত জীবন সাথী পেলে বেনু কি রাজী হোতো বিয়েতে? দুর কি সব ভাবছে, শৈবাল ওর মনগড়া মরীচিকা। ছোঁয়া যায় না, ধরা যাবে না, কাছে গেলেই মিলিয়ে যাবে, সে নিছকই বেনুর স্বপ্ন-পুরুষ।

আপন মনে হেসে বেনু এলো শেলীর বরকে দেখতে, ভদ্রলোককে দেখা হয়নি। বিয়ের কোনো অনুষ্ঠানেই মা ওকে পাত্রপক্ষের সামনে বের হতে দেননি, সে নিজেও আগ্রহী ছিলো না, যার সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো, তার সামনে যেতে স্বচ্ছন্দ বোধ করতো না, শেলীও স্বাভাবিক থাকতে পারতো না হয়তো সুতরাং যা কিছু করার,সে অন্তরালে থেকেই করেছে।

যাই হোক, বিয়ে বাড়ির ভীড়ে ওকে আলাদা করে চিনবে না বরপক্ষ তাই স্বাভাবিক মেয়েলী কৌতূহলে বর মঞ্চের কাছে এলো বরকে দেখতে। বরকে দেখে প্রথমে কিছু মনে হয়নি তারপরই যেন চমকে উঠলো বেনু। এই মানুষটিকে কোথাও দেখেছে সে। কিন্তু কোথায়, কখন দেখেছে! এই মুখ যে ভীষণ চেনা চেনা মনে হচ্ছে, ভালো মত লক্ষ্য করতেই আচমকা ওর শরীর ঝিমঝিম করে উঠলো। সে কোথায় কোন পরিবেশে আছে, সব মুছে গেলো চেতনা থেকে। কেবল বরের সবল বলিষ্ঠ পৌরুষদীপ্ত চেহারা চোখের সামনে ভেসে রইলো।

এই মুখ ভুল হওয়ার নয়, তিল তিল করে গড়া যে মানব ছবি শয়নে স্বপনে জাগরণে দেখেছে। যাকে অহরহ প্রতি মুহূর্তে কামনা করে নিজের অবচেতন মনের আতঙ্ক-ভয়-দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে চেয়েছে, এতো সেই-ওর স্বপ্নপুরুষ, শৈবাল!

স্তম্ভিত বাক‍্যহারা বেনুর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো। হ্নদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা নিঃশব্দ আর্তনাদ যেন বলতে চাইলো। না না, এযে অসম্ভব, এ হতে পারেনা। শৈবাল আমার কল্পনা, মনের মাধুরী দিয়ে গড়েছি ওকে। সে কোনো রক্ত মাংসের মানুষ নয়, সে আমার,একান্তই আমার খেয়াল, ভাবনা। কল্পলোক থেকে রূপকথার রাজকুমার যেমন আসতে পারেনা। তেমনি শৈবালও নয়। আকুলি বিকুলি করতে থাকে বেনু, সমগ্র সত্ত্বা ওর প্রতিবাদ করতে থাকে, না-না-না।

হঠাৎ ঘোর কেটে যায় বেনুর, ওকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মোটা এক বয়স্কা মহিলা বরের কাছে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,শৈবাল,তোর বৌ দেখে এলাম, কি অপরূপ দেখতে। আরো কি সব বলতে থাকে মহিলা।  শৈবাল! বরের নাম শৈবাল! বেনু আর কিছুই শুনতে পায় না। কেবল মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে দেখে, গভীর কালো মায়াবী দুটি চোখ তুলে হাসছে শৈবাল। শুভ্র সুন্দর সুগঠিত দাঁতে ঝিলিক তুলে, মুক্তার মত বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে পুরুষের প্রশস্ত ললাটে। শৈবাল, শৈবাল, শৈবাল-ধীরে মৃদু স্বরে উচ্চারণ করে বেনু। তারপরই ঘোর অন্ধকার গ্রাস করে বেনুকে, টলে পড়ে যেতে যেতে আবছা ভাবে দেখে সে, শৈবাল ছুটে আসছে ওকে ধরতে। কিন্তু না ওর শৈবাল নয়। শৈবাল যে কেবলই এক মনোরম মরীচিকা। যাকে ধরা যায় না, পাওয়া যায় না। কাছে গেলেই মিলিয়ে যায়, অসহায় বেনু চেতনা হারিয়ে পড়ে গেলো। পতন রোধ করার কোনো অবলম্বন পেলো না।

সমাপ্ত

 

 

 

 

%d bloggers like this: