মানসিক চাপ দূর করতে বা মনোযোগ বাড়াতে সঙ্গী করুন চুইংগাম

আত্রেয়ী দো: আগের দিন চুইংগামের ইতিহাস ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎই ছোটবেলার কিছু ঘটনা স্মৃতিপটে ভেসে উঠলো। ছোটতে আমরা কোয়ার্টারে থাকতাম। কোয়ার্টারগুলো ছিল বি.ডি.ও অফিসের বাউন্ডারির মধ্যে। সেই বাউন্ডারি পেরিয়েই ছিল রাস্তা আর রাস্তার ওপারে ছিল নকুলদার দোকান। মূলত দোকানটি ছিল চকলেট-বিস্কুটের। হয়তো আরো অনেক কিছুই থাকতো দোকানে কিন্তু সেগুলো আমার আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দুতে ছিল না, তাই এখন আর মনে পড়ে না। তবে বর্তমানে আর সেই দোকানের কোন অস্তিত্ব নেই। দোকান ভেঙ্গে গড়ে উঠেছে ফ্ল্যাট। তবে পাশাপাশি গড়ে উঠেছে নিত্য নতুন অনেক দোকান। ছোট প্যাকেটের মধ্যে হরেক রকম চকলেট সাজিয়ে নকুলদাই আমায় রাস্তা পার করে পৌঁছে দিয়ে আসতো। প্যাকেট ভর্তি রকমারি চকলেটের মাঝে অবশ্যই থাকতো দু-তিনটে বাবলগাম। আমি ছোটোতে বাবলগাম খুব পছন্দ করতাম। অনেকেই দেখতাম কি সুন্দর বাবলগাম চিবিয়ে মুখে বাবল তৈরি করছে। কিন্তু অনেক চেষ্টাতেও আমি তা পারতাম না। সেই থেকে কিছুটা হতাশ হয়েই বাবলগাম চিবোনো কমিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার আর বাবলগামের সখ্যতা সহজে ভাঙার ছিল না। কিছুদিন বাদেই ঠান্ডা লেগে আমার প্রচন্ড কানে ব্যাথা শুরু হয়। ডাক্তারকাকু কিছু ওষুধ লিখে দিলেন আর সাথে বললেন চুইংগাম চিবোতে। সময়ে সময় ওষুধ খাওয়ানোর দায়িত্ব মায়ের হলেও চুইংগামের কথা কাউকে মনে করাতে হতো না। তারপর বড়ো হওয়ার সাথে সাথে চকলেট, চুইংগাম সবই অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে। আগের দিন আমার সাধের এই চুইংগামকে “অনর্থক চিবোনোর জিনিস” বললাম, কিন্তু পরে নিজেই ভাবতে বসলাম আদৌ কি অনর্থক?  নাকি এর পিছনেও লুকিয়ে আছে নানান উপকারী প্রভাব? চলুন জেনে নিই।

 

 

১. মনোযোগ বৃদ্ধি :  প্রায়শই নানান কারণবশত আমরা কোনোকিছুতে মনোযোগ দিতে পারিনা। ফলে কাজ ব্যাহত হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটে পড়ালেখাতে। এই সমস্যা দূর করতে সঙ্গী করুন চুইংগাম।

২. স্মৃতিশক্তির উন্নতি : অনেক গবেষকদের মতে ক্রমাগত চুইংগাম চিবোলে মানসিক বিকাশের সাথে সাথে হৃদ্স্পন্দনের হার এবং রক্ত প্রবাহের হার বৃদ্ধি পায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, চুইংগাম চিবোলে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের মাত্রা ২৫-৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পায় ফলে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং স্মৃতিশক্তির উন্নতি হয়।

৩. মানসিক চাপ বা স্ট্রেস হ্রাস : বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে চুইংগাম চিবোনোর মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া সহজ হয় ফলে স্ট্রেস হরমোন কম নিঃসরণ হয়। তাই মানসিক চাপ কমাতে চুইংগাম বেছে নিন।

৪. দাঁতের যত্নে : দাঁতের যত্নে চুইংগামের বিশেষ ভূমিকা আছে। গবেষণায় জানা গেছে কম চিনি যুক্ত চুইংগামগুলি টুথপেস্ট ও মাউথ ফ্রেশনার হিসেবে কাজ করে। আমেরিকান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন এর একটি রিপোর্টে জানা যায়, খাওয়ার পর কুড়ি মিনিট মতো চুইংগাম চিবোলে দাঁতের ক্ষয় রোধ করা যায়। মুখের ভিতরে বিভিন্ন ক্ষতিকারক জীবাণু ধ্বংস করতেও চুইংগাম উপকারী।

৫. দৈহিক ওজন কমানো : ডায়েটিংয়ের চক্করে পরে খুচরো খিদে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন? সঙ্গে রাখুন চুইংগাম। চিনি ছাড়া যে সমস্ত চুইংগাম পাওয়া যায় সেগুলি বেছে নিন। চুইংগাম চিবোনোর জন্য আপনার ক্যালোরি কাউন্টও বাড়বে না উল্টে খাবারের রুচিও কমাতে সাহায্য করবে। তাই চুইংগাম চিবিয়ে কমিয়ে নিতে পারেন তৈরি দৈহিক ওজন।

৬. ধূমপানের আসক্তি কমায় : ক্ষতিকারক জেনেও ধূমপানে আসক্ত মানুষের সংখ্যা অগুনতি। যে কোন নেশার দ্রব্যই সহজে পিছু ছাড়ে না। নেশার হাত থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে মানসিক দৃঢ়তা এবং সেই সাথে কিছু সুঅভ্যাস করে তোলা। দীর্ঘক্ষণ চুইংগাম চেবানোর ফলে ধুমপানের প্রতি আসক্তি কমে।

৭. মর্নিং সিকনেস থেকে রেহাই : অনেকেরই মর্নিং সিকনেস অর্থাৎ সকালবেলা বমি-বমি ভাব,খাবারে অরুচি ইত্যাদির সমস্যা রয়েছে। চুইংগাম এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।

৮. বিমান যাত্রায় উপকারী : বিমান যাত্রায় উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে বায়ুর চাপ কমে । ফলে ইয়ার পপিং অর্থাৎ কানের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ চাপের সামঞ্জস্য জনিত সমস্যা হতে পারে। চুইংগাম চেবানোর ফলে চোয়ালের নড়াচড়া হয় এবং সেই সাথে লালা নিঃসরণ হয়। ফলে কানের আভ্যন্তরীণ চাপের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আরও একটি চাপের সৃষ্টি হয়। তাই ইয়ার পপিংয়ের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

৯. অ্যাসিড রিফ্লাক্স : গবেষণায় জানা গেছে চুইংগাম চিবোনোর ফলে লালারসে ক্ষারের মাত্রা বেড়ে যায়। তাই চুইংগাম শরীরের বিষাক্ত অ্যাসিডিক জিনিসকে প্রশমিত করে দেহে অ্যাসিড-ক্ষারকের নিরপেক্ষতা বজায় রাখে।

১০. জলের চাহিদা মেটাতে : চুইংগাম চিবোনোর ফলে লালা নিঃসরণ হয়, ফলে জলের চাহিদা কিছুটা মেটে।

১১. রিভাইটিলাইজার :  চুইংগামে গ্লুকোজ থাকে যা চমৎকার একটি রিভাইটিলাইজার। খেলার মাঠে খেলোয়াড়রা অনেকেই এই কারণে চুইংগাম চিবোন।

স্বল্পমূল্যের সহজলভ্য জিনিসটির উপকারী দিকগুলি তো জানলাম। তবে সব জিনিসেরই ভালো-খারাপ উভয় দিক থাকে। অধিক চুইংগাম সেবনে হতে পারে নানান ধরনের সমস্যা –

১. চুইংগামে উপস্থিত চিনি, অম্ল জাতীয় উপাদান এবং প্রিজারভেটিভ দাঁতের ক্ষয় করতে পারে।

২. বেশি চুইংগাম চিবোলে অনেকক্ষণ চোয়ালের নড়াচড়া হয়, ফলে হতে পারে টেমপোরোমেন্ডিবুলার জয়েন্ট ডিসঅর্ডার। এছাড়া মাথা ব্যথারও সৃষ্টি হতে পারে।

৩. অধিক চুইংগাম সেবনে হতে পারে ইরিটেবল বাউল সিনড্রোম(আই.বি.এস)।

৪. অত্যধিক চুইংগাম সেবনে লালা নিঃসরণ হয়। তবে অধিক লালা নিঃসরণে বিপাক কার্য ব্যাহত হতে পারে।

৫. চুইংগামে উপস্থিত সিন্থেটিক উপাদান ভ্রূণের বৃদ্ধি ব্যাহত করে, তাই গর্ভাবস্থায় চুইংগাম এড়িয়ে চলুন।

৬. অধিক চুইংগাম সেবন ক্ষিদে বাড়াতে সাহায্য করে, ফলে বাড়তে পারে দৈহিক ওজন।

 

%d bloggers like this: