সূর্যটাকে অস্ত যেতে দেব না

প্রাক্তন সাংবাদিক,সম্পাদক, প্রশাসক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ৺অমিয় কুমার মুখোপাধ্যায়  স্মরণে বিশেষ প্রতিবেদনে সুমিত দাঁ

সূর্যটাকে অস্ত যেতে দেব না….

“তোমার শঙ্খ ধূলায় পড়ে কেমন করে সইব।

বাতাস আলো গেল মরে, একি রে দুর্দৈব ।

লড়বি কে আর ধ্বজা বেয়ে, গান আছে যার ওঠনা গেয়ে,

চলবি যারা চলনা ধেয়ে–আয় না রে নিঃশঙ্ক।

ধূলায় পড়ে রইল চেয়ে ওই-যে অভয়শঙ্খ”

রবি ঠাকুরের এই উদ্ধৃতি দিয়েই শুরু হোক আমাদের নতুন করে পথচলা। শুরু হোক আমাদের হারিয়ে যাওয়া মানুষটির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। যার জীবন-দর্শন- আগামী প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠবে ওই- ‘অভয় শঙ্খের’ মত। তিনি আর কেউ নন, আমাদের সবার প্রিয়-৺অমিয় কুমার মুখোপাধ্যায়, যিনি থাকোদা নামেই সর্বজন বিদিত। তার সম্পর্কে দু-চার কথা না লিখলে, আমি নিজেকে কোনদিনই ক্ষমা করতে পারব না। তাই-“নীরব ব্যাথার জল-তরঙ্গে সুরকে খোঁজার” মত আসুন আমরা তাঁকে অবগাহন করি।

সময়ের আলোকে তিনি ছিলেন, এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। পিতা স্বর্গীয় দূর্গা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং মাতা স্বর্গীয়া কমলা বালা দেবীর প্রথম সন্তান। বর্তমানে তিন বোন এখনও জীবিত। জন্ম ১লা আগস্ট ১৯২৮ সালে, হুগলির মানকুন্ডুর বামুনপাড়া লেনে। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি শুধু মেধাবীই ছিলেন না। খেলা-ধূলা, গান বাজনা, এবং সাহিত্যচর্চাতেও যথেষ্ট মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছিলেন।

১৯৫৯ সালে হুগলি জেলার শ্রীরামপুর কলেজ থেকে বি-এ পাশ করেন। পরে জার্নালিজম নিয়ে পড়াশুনা করে সসম্মানে উত্তীর্ণ হন। ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজ্য ও রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। এবং পরবর্তী কালে যোগদান করেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে।  পড়াশুনা শেষ করে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত একটি মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক রূপে যোগদান করেন। ১৯৫৪ সালে বসুমতি পত্রিকায় প্রথম সাংবাদিক হিসাবে যোগাদান করেন। পরবর্তী কালে যুগান্তর, আনন্দবাজার, স্টেটসম্যান, অমৃতবাজার পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে যোগ দেন এবং বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।

তাঁর বিশেষ আকর্ষন ছিল সমাজসেবা মূলক কাজকর্মের প্রতি। যা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল প্রতিটি মানুষের মনের মনি কোঠায়। মানুষের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস আর ভালোবাসাই ছিল তাঁর আদর্শের মূল মন্ত্র। গরীব-বড়লোক দেখতেন না,  দল দেখতেন না তিনি, শুধুই কাজ বুঝতেন। অনেক দুঃখী-অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের দুঃখ-দুর্দশা দুরীকরণের চেষ্টাও করে গেছেন মৃত্যুকাল পর্যন্ত। যা তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে চিরকাল। আমার ব্যক্তিগত জীবনে সাংবাদিকতার সূত্রে তাঁর সঙ্গে আলাপ। আর সেই সূত্র ধরেই আমার সাংবাদিক জীবনের পথ চলা শুরু। বিয়াল্লিশ বছর ধরে, যে মানুষটির সঙ্গে আমি একাত্মভাবে জড়িয়ে ছিলাম তা কখনই ভোলার নয়। তাঁর আদর্শ, তাঁর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাঁর জীবন-দর্শন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজে। তাই তাঁকে বাদ দিয়ে আমি বা আমরা কোন কিছুই ভাবতে পারি না।

রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে মানুষের জন্য তাঁর দায়বদ্ধতার কথা কখনই অস্বীকার করা যাবে না। কারণ একদিকে তিনি যেমন ছিলেন অকৃতদার ব্যক্তি অন্যদিকে সহজ-সরল জীবন-যাপনের মধ্যে দিয়েই তিনি তাঁর ন্যায়নীতি-পরায়নতা এবং আদর্শ থেকে কোনদিন বিচ্যুত হননি। পরন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক জটিলতার মধ্যে দাঁড়িয়েও মানুষের মধ্যে মূল্যবোধকে জাগরিত করার আপ্রাণ চেষ্টা তিনি করে গেছেন। যা আমাদেরকে গর্বিত করে। তিনি চিরকুমার থেকেছেন শুধুমাত্র পারিবারিক অস্থিরতার কারণেই নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার জন্য নিজেকে বিবাহ সূত্রে বাঁধতে চাননি।

তাঁর রাজনৈতিক জীবন ও কর্মকান্ডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনার আগমন হয় ১৯৬৪ সালে। ওই বছরেই তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে প্রথম নির্বাচিত হন বৈদ্যবাটী পৌরসভায়। আর সেখান থেকেই ক্রমান্বয়ে তাঁর উত্তরণ ঘটতে থাকে। পরপর দশবার কাউন্সিলর হিসাবে নির্বাচিত হয়ে হুগলি জেলার সুপ্রাচীন বৈদ্যবাটী পৌরসভার সদস্য পদ গ্রহণ করেন। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পর পর দু’বার পৌরসভার পৌরপ্রধান পদে অভিসিক্ত হন। ইতিমধ্যে পৌরসভার দুর্বল বিভাগীয় দপ্তর গুলির প্রতি বিশেষ নজর দেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্য বিভাগীয় দপ্তরে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। ১৯৯৫ সালে পৌর এলাকার জনসাধারণের স্বার্থে (আই-পি-পি-৮) হেলথ্ সেন্টারের অবতারণা করেন। এবং সেই সঙ্গে অনেক শিক্ষিত ও অশিক্ষিত অসহায় মহিলাদের নিয়োগ করে তাদের আর্থিক সংস্থানের বন্দোবস্ত করে দেন। আর অল্প দিনের মধ্যে মৃত স্বাস্থ্য বিভাগের পরিকাঠামোকে চাঙ্গা করে তোলেন।

এবার ফিরে আসছি, তাঁর সাহিত্য-সংস্কৃতির কথায়। তিনি শুধুমাত্র সাংবাদিকতা বা সমাজসেবার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি। সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল প্রবল। তার জলন্ত প্রমাণ আমরা পাই ‘কেয়া’  সাহিত্য পত্রিকার প্রকাশনা ও সম্পাদনার মধ্যে দিয়েই। যা আজও অমলিন। ২০২০ সালের শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশের মুহূর্তেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আর তার এই অসমাপ্ত কাজের দায়িত্বভার দিয়ে যান কয়েকজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির উপর।

আজ থেকে ৮০ বছর আগে ১৯৪০ সালে যে “কেয়া” পত্রিকার পথচলা শুরু করেছিলেন ডাঃ বিভূতি ভূষন বন্ধ্যোপাধ্যায়, ৺সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এবং লিখিলেশ সেন এই এয়ী যোদ্ধা আজ আর আমাদের মধ্যে নেই ঠিকই, কিন্তু রেখে গেছেন তাঁদের সৃজিত মূল্যবান সৃষ্টি। অনেক যুদ্ধ অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে যে কাগজকে তাঁরা তিল তিল করে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তা আজ আমাদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। আর সেই সম্পদকে তাঁদের স্মৃতি রঞ্জিত করে রাখার জন্য সম্পূর্ণভাবে চালিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্বভার তিনি (অমিয় মুখোপাধ্যায়) নিজে কাঁধে তুলে নিলেন। এবং মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করে এক জলন্ত নজির রেখে গেলেন। যা শুধু আমাদের কাছেই নয়, হুগলী জেলা তথা পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সকল সাহিত্য প্রেমীদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

তাই আসুন,  আজ আমরা সবাই মিলে সেই মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানাই। শ্রদ্ধা জানাই তার সম্পাদিত ‘কেয়া’ পত্রিকাকে। একটি পত্রিকা শুধুমাত্র মনোরঞ্জন নয়। শুধুমাত্র শব্দের বিলাসিতা নয়,  একটি পত্রিকা-“একটি চেতনার জন্ম দেয়।” একটি পত্রিকা – ‘জীবনকে চিনতে শেখায়। তাই আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ- সকল সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুদের কাছে, সকল রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক কলা-কুশলীদের কাছে- তারা যেন জীবন বোধের এইধরনের ছোট্ট ছোট্ট মাধ্যমগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে দুহাত ভরে ভালোবাসা আর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। আর সেটাই হবে তাঁর প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।

One thought on “সূর্যটাকে অস্ত যেতে দেব না

Comments are closed.

%d bloggers like this: