হৃদরোগ থেকে বাঁচতে চা পান

আজ ২১ মে, আজকের দিনটি সারা বিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক চা দিবস হিসেবে। চা পান কতটা উপকারী ও চায়ের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোকপাত করলেন সাংবাদিক আত্রেয়ী দো

সকালে এক পেয়ালা গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক না দিলে যেন ঘুমের আমেজটা ঠিক কাটে না। তা ঘুমের আমেজ কাটানোই হোক, বা বন্ধুদের আড্ডা, কাজের বিরতি হোক বা তড়িঘড়ি অতিথি আপ্যায়নে কিংবা হোক রাত জেগে পরীক্ষার প্রস্তুতি-সঙ্গী হিসেবে চায়ের জুড়ি মেলা ভার। আজকের দিনটি রইল চা-প্রেমীদের জন্য। আজ ২১শে মে, আজকের দিনটি সারা বিশ্বজুড়ে পালিত হয় “আন্তর্জাতিক চা দিবস” হিসেবে।

ভারতের উত্তর-পূর্ব এবং চিনের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ চায়ের উৎপত্তিস্থল বলে মনে করা হয়। চায়ের জন্ম এবং প্রচলন নিয়ে তিব্বতে এক উপকথার প্রচলন রয়েছে। তিব্বতের রাজকুমার ধর্ম একদিন কঠোর তপস্যায় বসেন। সেই তপসায় তিনি সিদ্ধিলাভ করেন নি। মানুষের উপকার করার জন্য যে দৈব ক্ষমতা তিনি অর্জন করতে চেয়েছিলেন তা না পারায়, ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি নিজের দুই চোখের পাতা উপড়ে ফেলে দেন। দেখতে দেখতে সেই দুটি চোখের পাতা থেকেই নাকি দুটি পাতা এবং একটি কুঁড়ি সমেত চা গাছের জন্ম হয়। এভাবেই সভ্যতা ধর্মের কাছ থেকে উপহার পায় এক স্বাস্থ্যকর পানীয়। যদিও এটি একটি পৌরাণিক কাহিনী তবুও চীন-তিব্বতে চায়ের জনপ্রিয়তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকাংশে বেশি।

চিন, নেপাল, জাপান, জাভা, সুমাত্রা, ভারতের আসাম, দার্জিলিং, কোয়েম্বাটুর, নীলগিরি এবং কোচিনে চা উৎপাদন হয়। একটি সমীক্ষায় জানা গেছে, ২০০৩-২০০৪ সালের মধ্যে ভারতে প্রায় ৮৫০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল এবং প্রায় ২০০ মিলিয়ন কেজি চা ১৪০০ কোটি টাকায় বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছিল। ২০১২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি ব্ল্যাক টি উৎপাদন হয় ভারতে। শুধু উৎপাদনেই নয়, ব্ল্যাক টির গ্রাহক সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি ভারতে। ২০১৩ সালে চা কে ‘আন্তর্জাতিক পানীয়’ আখ্যা দেওয়া হয়। জলের পরে চা ই হলো বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা পানীয়। রিফ্রেসিং ড্রিংক হিসেবে বহু দেশেই চায়ের জনপ্রিয়তা শীর্ষে। সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতি সেকেন্ডে, মানুষ ২৫,০০০ কাপ চা খায়, যার অর্থ প্রতিদিন দুই বিলিয়ন কাপের বেশি চা খাওয়া হয়।

চা একটি স্বাস্থ্যকর পানীয়। চায়ে রয়েছে বহু উপকারী উপাদান, যেমন ক্যারোটিন, রাইবোফ্ল্যাভিন, নিয়াসিন, প্যান্থোথেনিক অ্যাসিড এবং অ্যাসকরবিক অ্যাসিড। কিন্তু ব্ল্যাক টি প্রস্তুতির সময় এই উপাদানগুলি নষ্ট হয়ে যায়, তবে গ্রিন টিতে এই উপাদান গুলি উপস্থিত থাকে। তাই ব্ল্যাক টি অপেক্ষা গ্রিন টি অধিক উপকারি। চায়ে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রপার্টি যেমন-ফ্ল্যাবোনলস, ফ্ল্যাভোনডিওলস, ফ্লেভোনয়েডস এবং ফেনোলিক অ্যাসিড যা কোষের ক্ষয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করে, টিউমারের বৃদ্ধিতে সহায়ক এনজাইমগুলিকে প্রতিরোধ করে, ক্যান্সার কোষগুলির বৃদ্ধিতেও বাধা প্রদান করে।

গ্রিন টিতে ক্যাথাচিন এবং ব্ল্যাক টিতে থিয়ারুবিজিনস এবং থিয়াফ্ল্যাভিনস নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। NIN এর একটি সমীক্ষায় জানা যায় গ্রিন টি এবং ব্ল্যাক টিয়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণ নির্ধারিত মানদণ্ডের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভিটামিনসের থেকে অনেক অংশে বেশি। শুধু তাই নয় চায়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণ পালং শাক এবং অন্যান্য শাকসবজির থেকেও বেশি। এক কাপ চায়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণ এক কাপ কমলালেবুর রসের চেয়ে প্রায় ৪০০ শতাংশ গুণ বেশি। একটি গবেষণায় দেখা গেছে বেশি মাত্রায় ফ্ল্যাভোনয়েডস গ্রহণ হৃদ্ রোগের (করোনারি হার্ট ডিজিজ) ঝুঁকি কমায়, যা চায়ে অধিক মাত্রায় উপস্থিত। এক কাপ চায়ে প্রায় ২০০mg ফ্ল্যাভোনয়েডস থাকে।

তবে চা শুধু স্বাস্থ্যকর উপাদান নয়, কর্মসংস্থান ও সংস্কৃতিতেও চায়ের এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বর্তমানে চা উৎপাদন জীবিকার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস। বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক চা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো চায়ের বাণিজ্যকরণ। চায়ের ব্যবহার আরো সম্প্রসারিত হলে,বাড়বে চায়ের বিক্রি। ফলে চা শ্রমিকেরা লাভবান হবেন এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে চিনে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। তবে ভারতবর্ষে চায়ের চাষ শুরু হয় ১৮১৮খ্রিস্টাব্দে। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা সিলেটে প্রথম চা গাছ আবিষ্কার করে। সিলেটের মালনীছড়ায় ১৮৫৭ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। বিশ্বের চা উৎপাদনকারী দেশগুলি প্রথম দিকে ,২০০৫ সালের দিক থেকে ১৫ই ডিসেম্বর দিনটিকে আন্তর্জাতিক চা দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে। ২০১৫ সালে ভারত সরকার জাতিসংঘের ফুড এন্ড এগ্রিকালচার এন্ড নেশনস এর কাছে চায়ের গুরুত্ব উদযাপনের জন্য সারা বিশ্বের নিরিখে একটি দিন ধার্য করার জন্য আবেদন জানায়। সেই মর্মে জাতিসংঘ ২০১৯ সালের ২১শে ডিসেম্বর তারিখে, ২১শে মে দিনটিকে আন্তর্জাতিক চা দিবস হিসেবে ধার্য করে। তাই ২০২০ সাল থেকে ২১শে মে দিনটি আন্তর্জাতিক চা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘের লক্ষ্য হল আন্তর্জাতিক চা দিবস পালনের মাধ্যমে চা উৎপাদনকারী দেশগুলিকে সহায়তা করা।

%d