গল্পমালা (নিরন্ন মুখ)

সংবাদ প্রতিখনের সাহিত্যের পাতায় ছোট গল্প নিয়ে থাকছেন কলকাতা থেকে লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক এবং বাচিক শিল্পী অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়

নিরন্ন মুখ

 

নির্ঘুম রাতে বিছানা ছেড়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াতেই এক আকাশ চাঁদ জ্যোৎস্না ঝরে পড়লো নির্জন বনপথে। একা একা বেরিয়ে পড়েছি।প্রতি বছর এখানে আসি আমি। বনবাংলোর ছোট্ট ঘরে কেমন যেন একটা হালকা গন্ধ মাখানো রাত। সেজন্যই বোধহয় ঘুম আসছে না।

আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। জ্যোৎস্নার চাদর ফুঁড়ে রাতের বারান্দায় ভেসে বেড়ায় হালকা ধোঁয়া। সিগারেটের  কুণ্ডলী পাকিয়ে বাতাসে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। বেশ দেখতে লাগছে।

এ সময় কবিতা পাচ্ছে। উঠতে যাবো এমন সময় গাছের ফাঁকে একটা করুন মুখ চোখে পড়লো। থমকে গেলাম। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছি সেইদিকে। চোখ বন্ধ করে খুলতেই কিছু নেই। কেউ নেই। তাহলে কী দেখলাম এইমাত্র ? সে কি চোখের ভুল নাকি-

একটা খুট করে শব্দ। ঘরের দরজায় একটা ছায়া মূর্তি। দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় আমাকে ডাকছে। আমি মন্ত্র মুগ্ধের মত উঠে দাঁড়ালাম। চেয়ার ছেড়ে। ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলাম। জানলা গলে হালকা জ্যোৎস্নার আনাগোনা। আমি আলো জ্বলতে যাবো এমন সময় হাতের ইশারায় বারণ করলো সে। নারী মূর্তি। সে আমার  বিছানায় বসে পড়েছে ততক্ষণে।

আমিও বসলাম। ও আরো সরে এলো আমার কাছে। একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে। আমার শরীরেও। মনের ভেতর একটা অস্থিরতা বাড়ছে। বুকের স্পন্দন দ্রুত এখন।

– কেমন আছো?

নারী কণ্ঠে প্রশ্ন।

– ভালো। কিন্তু আপনি কে?  এত রাতে এখানে এই বাংলোয় কী করছেন?

ও দু হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। খিলখিল করে হেসে বললো-ভয় পেলে নাকি? আমি নীলিমা সেন। তোমার নীল। মনে পড়ে?

ভুলে গেলে সেদিনের কথা ?

আমরা এই বাংলোতেই উঠেছিলাম। তারপর সেই ভয়ঙ্কর ঝড়ের রাত। মনে পড়ে?

চমকে উঠলাম। নীল! কিন্তু-।

কোন কথা বলার ভাষা নেই। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কোন বোধ কাজ করছে না।

– জল ।

বলতেই নীল টেবিল থেকে জলের গ্লাসটা এনে আমার সামনে ধরলো। আমি গ্লাস ধরতে গিয়ে ওর স্পর্শ পেলেন। কী ভীষন ঠান্ডা সে স্পর্শ। চোখ বন্ধ করে জল

খেলাম। চোখ খুলতেই দেখি একটা নিরন্ন বিষন্ন ক্লান্ত মুখ আমার মুখের কাছে।খুব কাছে।আমার বুকের ওপর ঠান্ডা হাত। একটা হিম শীতল স্রোত আমার শরীর বেয়ে নামছে। আমার ঠান্ডা লাগছে।  শীত করছে। প্রচণ্ড শীত।

– উফ কী বিভৎস। তুমি চলে যাও এখন থেকে।

আমার আর কিছু মনে নেই। পরদিন অনেক বেলা হলো ঘুম ভাঙ্গতে। চোখ খুলতে টের পেলাম বিছানায় নয় বাগানের মাঝে ঘাসের কার্পেটে লেপ্টে আছে আমার শরীর। মুখের সামনে ঝুঁকে  পড়েছে কিছু অচেনা অজানা মুখ।

বাংলোর কেয়ারটেকার সবাইকে সরিয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই আমি ওনার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালাম। আমি এখানে এলাম কিভাবে?

– সেটা আমিও তো ভাবছি। উনি বললেন।

গত রাতের ঘটনা মনে পড়ে গেল।  ঘরে ফিরতে ফিরতে মনে মনে ভাবতে লাগলাম নীল কী করে !

আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেছি। সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার পর নীল কে আর খুঁজে পাইনি। বুকের ভেতর গভীর ব্যাথা লুকিয়ে আজও আমি একা একা থেকে গেছি।

না। আজই ফিরে যাবো। নাকি আর একটা দিন থেকে যাবো।আজ রাতেও যদি নীলের দেখা পাই।

না। সে রাতে নীল আর আসেনি। সারারাত জেগে আমি অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু না। নীলের দেখা আর পাই নি কোনোদিন। বার বার প্রতিবছর এই দিনটিতে আমি ফিরে আসি এই নির্জন বাংলোয়। নীলের সঙ্গে দেখা করতে।

হঠাৎ করে বৃষ্টি নামলো। আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বৃষ্টির ঝাপটায় আমার শরীর ভিজছে।ভালো লাগছে। আমি ঝাপসা চোখে নীলকে দেখতে পাচ্ছি। ও বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে  নাচছে। আমি বহু বছর আগের সেই দিনটায় ফিরে গেলাম।

একটা চোরা সুখ বুকের ভেতর তোলপাড় করতে লাগলো।

%d bloggers like this: