গল্পমালা (ইতি অনুপমা)

অন্যরকম লেখা নিয়ে সংবাদ প্রতিখনে এবারের গল্পমালায় হুগলি জেলার বৈদ্যবাটি থেকে প্রবীণ কবি-সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সুমিত দাঁ

 ইতি অনুপমা

গল্পের অঙ্গনে কিছু কথা যখন কবিতা হয়ে ওঠে

প্রিয় সুমনা,

আজ অনেক বছর পর তোকে আবার চিঠি লিখছি। অনেক কষ্টে তোর ঠিকানাটা আমি যোগাড় করেছি। আমি জানি, তুই হয়তো একটু অবাকই হবি। কিন্তু, বিশ্বাস কর-এছাড়া আমার আর কোন উপায়ই ছিল না। আমার এই বত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনের একটা ছোট্ট গল্প উপহার স্বরূপ তোকে পাঠালাম। আশা করছি, আমার এই গল্পটা পড়তে পড়তে নিশ্চই তোর কলেজ জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী ‘অনুপমা’ অর্থাৎ অনু’র মুখটা তোর চোখের সামনে ভেসে উঠবে। আর ঠিক তখনই শুরু হবে আমার- “সমাজ বনাম জীবনের-মিডল ক্লাস লড়াই।”

আসলে কি জানিস, সংসারের সবচেয়ে কাছের মানুষেরাই কেউ আমাকে বুঝতে পারলো না। বুঝতে চায়নি কোনদিন। আমার চাওয়া-পাওয়ার কোন মূল্যই দেয়নি তারা। আমার মনের কোনায় জমে থাকা ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলো যা এতদিন মাটির নীচে সমাধিস্থ ছিল তাকে পুনরায় জাগরিত করতেই আমার এই গল্পের অবতারনা। তোর ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে সময় করে পড়ে নিস। তবুতো জানবো, আর কেউ থাক বা না থাক, তুই তো আছিস। আমাকে নিশ্চই বুঝবি।

কি জানিস সুমনা, এই সংসার জীবনে আসার পর থেকে দিন আর রাতের সামঞ্জস্য করতে পারিনি কোনদিন। পাড়া-প্রতিবেশীদের বলতে শুনেছি ” সোনার প্রতিমে ঘরে এনেছ বৌদি-একটু যত্নে রেখো “

আজ এত বছর পর সেই কথাটা মনে পড়লে বড় হাসি পায় আমার। যে সোনার বর্ণ চুলোর ধোঁয়া আর হেঁশেলের জোয়াল টানতে গিয়ে হাড়-মাস কালি হয়ে গেলো, সেখানে কোথায় পাবে অনুপমা-সোনালি রোদ্দুর!

আজ এই মুহুর্তে রবী ঠাকুরের সেই কবিতাটা খুব-খুব মনে পড়ছে রে সুমনা। সেই যে সেই কবিতাটা– “নারীর আপন ভাগ্য কে জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার হে বিধাতা?”

আমার জীবনটাও ঠিক তাই। সংসারের আবর্তে পড়ে নিজের সদিচ্ছাগুলো ধুলোর আস্তরনে চাপা পড়ে গিয়েছে। আমার বাগানে পাবি না কোন ফুলের সৌরভ। পাবি শুধু-সংসারের আঁশটে গন্ধ, ঘসা-মাজা বাসনের শব্দ, আর আটপৌরে রন্ধন শালার ঘর্মাক্ত জীবন। সংসারের যাঁতাকলে ঘড়-ঘড় শব্দ ওঠে অবিরাম। এখানে শান্তি নেই, স্বাচ্ছন্দ্য নেই, স্বাধীনতা নেই। আছে শুধু অনাবিল দহন জ্বালার কাব্য। প্রেম-ভালোবাসা, স্নেহ-প্রীতি, ভক্তি-শ্রদ্ধার তাজা ফুলগুলো কবেই পড়ে আছে ভাঙ্গা পাত্রে। এখন প্রতিটি ভোরে সেই বাসি-পচা ফুলের দুর্গন্ধে ভরে ওঠে বাড়ির উঠোন। উহস্ কি ভয়ঙ্কর সেই দুর্গন্ধময় সহবাস।

জানিস সুমনা, এখন বড় কষ্ট হয় আমার। দম বন্ধ হয়ে আসা এক নরক যন্ত্রনা বয়ে বেড়ানোর মত আমাকেও সহ্য করতে হচ্ছে এই বিষময় বেঁচে থাকা। তুই বল– তিন-তিনবার আঁতুর ঘরের দ্বার পরিগ্রহ করে, চুলোয় ধোঁয়া দিয়ে ভাতের হাঁড়ি চাপানোর মত নির্বাক বেদনার ভার বইতে-বইতে কবে যে আমি প্রবীনা হয়ে উঠলাম তা আমি নিজেও জানিনা। একদিকে স্বামী-সন্তান,  শ্বশুর-শাশুড়ি, আত্মীয়-পরিজন সকলের প্রতি দায়-দায়িত্বের বোঝা আর অন্য দিকে রুক্ষ-শুষ্ক জল-বাতাসহীন সংসারে সবুজের সন্ধান এই দুয়ের টানা-পোড়েনে সেদিনের সেই অষ্টাদশী অনুপমার শিক্ষা-দীক্ষা, রুচিবোধ, তার লেখনি শক্তির অবদমনকে মেনে নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে আমার। তুই দূরে থাকলেও তুই আমার একমাত্র কাছের বন্ধু। যে আমার মনের কথা বুঝে নিতে পারতো। যে আমাকে কলেজ জীবনে আসার পর থেকে সাহস যুগিয়েছে। তুই ছিলিস আমার চলার পথের একমাত্র প্রেরনা। তাই, তোর কাছে আমার সবকথা জানিয়ে নিজেকে হাল্কা করতে চাই।

অথচ দেখ, সেই আমি তোদের অনুপমা, স্কুল জীবনে কত স্বপ্ন দেখেছিল। পড়া-শুনায় প্রথম বইতো দ্বিতীয় হইনি কোনদিন। ইচ্ছে ছিলো, কলেজ আর ইউনিভারসিটির চৌকাঠ ডিঙিয়ে নিজেকে একজন পরিনত লেখিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার। আমার কলেজ জীবনে কত লেখাই তো প্রকাশ হয়েছে দৈনিক কাগজ গুলোতে। একদিন আমাদের কলেজের অধ্যাপিকা অঞ্জনাদির সঙ্গে দেখা। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন – আরে অনু, কেমন আছিস? গতকাল কাগজে “নারীর সেকাল-একাল’ এর ওপর তোর একটা লেখা পড়লাম। ভীষন ভালো লেগেছে। সত্যি রে অনু, তোর প্রতিভাকে কুর্নিশ করি। আরও বড় হ। আরও সাহসী হয়ে উঠুক তোর লেখনী। আমার আশীষ সব সময় তোর সঙ্গে থাকবে।

সেদিন অঞ্জনাদির কথা গুলো শোনার পর আনন্দে বুকটা আমার ভরে উঠেছিল। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমার আর বড় হয়ে ওঠা হোলনা রে সুমনা। আমার স্বপ্ন-স্বপ্নই থেকে গেল। প্রতি মুহুর্তে পতি দেবতার মুখ ঝামটানি, শাশুড়ির কটূ কথা, আর ছেলে-মেয়েদের শাসন যন্ত্রের প্যাঁচে পড়ে নিজের অস্তিত্বটাকেই ভুলতে বসেছি। নিজের মতামত প্রকাশের কোন জায়গাই নেই সেখানে। কতবার প্রতিবাদি সত্বাটাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। পারিনি শুধুমাত্র বাবা-মায়ের কথা ভেবে। বড্ড অসহায় লাগে নিজেকে। কতবার এই সংসারের পরিগন্ডী থেকে বেরোবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু-না!  সেই যে কলেজ শেষ করে সংসারে ঢুকলাম, ব্যাস-চুলোয় ধোঁয়া দিতে দিতে হারিয়ে গেল আমার স্বপ্নের জগৎ। এখন শুধু মনে হয়, আমি সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগেই পড়ে আছি। যেখানে আমার জীবনের রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণগুলো একটু একটু করে রোপন করেছিলাম সেগুলো আজ ধূসর মলিনতায় ঢাকা এক বাকরুদ্ধ জীবনের ফসিল। ঠিক যেন একটা আস্ত স্ক্যালিটন এই সংসারের চারপাশে এক বুক নাভিঃশ্বাস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হয়তো তুই আমাকে দেখলে এখন আর চিনতেই পারবি না। আসলে, আমার জীবনের গল্পটা যে অনেক বড়। তাই সংক্ষেপে লিখছি। কলেজ জীবন শেষ হতে না হতেই দাদা-বৌদির সংসারে আমি একটা গলগ্রহ হয়ে উঠেছিলাম। বাবা-মা তো চিরকালীন রুগ্ন। যেন হেল্থ কেয়ার কোম্পানীর লাইক মেম্বারশিপই নিয়ে নিয়েছিল। তাই সবটাই দাদার ওপর ভর করে চলছিল এতদিন। কিন্তু ওই! বাড়িতে আইবুড়ো মেয়ে থাকলে যা হয়। আর টিউশানির টাকায়– কতটুকুই স্বাচ্ছন্দ্য বজায় রাখতে পারতাম। যা পেতাম তার সবটাই চলে যেত  বাবা-মায়ের ওষুধ আর আমার পড়াশুনার পেছনে। তাই দাদা একদিন আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলো বাবা-মায়ের কাছে। বাবা-মাও রাজী হয়ে গেল। আমি যে প্রতিবাদ করিনি তা নয়। কিন্তু ফল হল উল্টো। অশান্তির ভয়ে নিজেকে শামুকের মত গুটিয়ে ফেললাম। ব্যাস- আর কি! ওদের আনুগত্য বজায় রাখতে সানাই বেজে উঠল। কোন এক চটকলে চাকরি করা ছেলের সঙ্গে আমার বিয়েও হয়ে গেল। বিদায় বেলায় মনে হয়েছিল, আমি যেন সতী হতে সহমরণে যাচ্ছি। সেদিন আমার চোখের জলকে আর যেন রোধ করতে পারিনি। শ্রাবণের ধারার মত সব দুঃখ আর যন্ত্রনাগুলো একই সঙ্গে যেন আমার বেনারসির আঁচল ভিজিয়ে দিল। মুছে গেল জীবনের সব চন্দন শৈলী।

অথচ, দেখ সুমনা-তোদের সেই আমি, এক এবং অপ্রতিদ্বন্দি অনুপমা-আজ নোঙর ভাসিয়ে দিল কোন এক অজানা, অচেনা অকুল দরিয়ায়। আমি কি ভেবেছিলাম, যে আমাকে এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে? এই দুঃসময়ের বৈতরণী পার করতেই তোকে এই চিঠি লেখা। আমি জানি সুমনা, আমার জীবনে আরও অনেক বড় ঝড় আসবে। কিন্তু তাবলে আমার কলম আমি আর থামিয়ে রাখবো না। কারণ, আমাদের মত আরও অনেক ‘অনু’রা আজও বুকে পাথর চাপা দিয়ে আছে। গ্রাম-গঞ্জ-শহরের আনাচে-কানাচে একটু কান পাতলেই শুনতে পাবি তাদের কান্নার শব্দ। অথচ দেখ-যাদের জন্য একদিন আমিই কলম ধরে ছিলাম আজ সেই কি না! যাক সে কথা।

আমার এখন কি মনে হয় জানিস, মনে হয়-এই সংসারের মায়া-জাল কাটিয়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে দিগন্ত হয়েছে শেষ। যেখানে কোন যন্ত্রনা নেই, কোলাহল নেই, আছে শুধু নৈঃশব্দ্যময় ভোরের মত সরলতা। আর পদ্ম পাতায় জমে থাকা জলবিন্দুর মত অখন্ড ভালোবাসা। যেখানে গেলে আমি খুঁজে পাবো নির্মল শান্তির এক চিলতে সোনালী রোদ্দুর।

তুই হয়তো বলবি-এটা তোর অভিমানের কথা। তোর মত মেয়ের  মুখে একথা মানায় না।

হ্যাঁ, একদম ঠিক বলেছিস। কিন্তু কি করবো বল? আমি যে বড় একা হয়ে গেছিরে। যাদেরকে পাশে পাবো ভেবেছিলাম তারাই আজ আমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আমি জানি, জীবনের সব মানে খুঁজে পাওয়া যায় না। তবুও, বিশ্বাস কর, আমার মেরুদণ্ড এখনও ঋজু হয়ে যায়নি। এখন কলমের ডগায় জমে আছে বিদ্যুতের ফলক। তুই সাহায্য করলে সবকিছু ঝলসে দিতে পারি। তুই পাশে থাকলে আগুনের মা হতে পারি। তাই বলছি আমি আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করতে চাই রে সুমনা। আমার ছোট্ট খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘরেই না হয় কাটবে আমার জীবনের বাকি কটা দিন। যা হবে একান্ত ভাবে আমার নিজস্ব এক পৃথিবী। আর কলমই হবে আমার একমাত্র হাতিয়ার। এই ভেঙ্গে পড়া সমাজের কুশপুত্তলিকা দাহ করব আমি। গড়ে তুলব নতুন সমাজ-নতুন সংস্কৃতি-নতুন জীবন।

নিয়ে যাবি আমায় তোর কাছে? তোর ওই স্বাধীন জীবনের ছোট্ট এক টুকরো আঁচলে ঠাঁই দিবি আমায়? বিশ্বাস কর-একটা অসম্ভব ঘৃনায় বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে আমার মন। নিজেকে নতুন করে বাঁচার জেহাদ ঘোষনা করতে চাই আমি। তোর উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম। প্লিস্-আমার এই অন্যায় আব্দারটুকু না হয় আজ রাখলি।

ভালো থাকিস।

ইতি ‘অনুপমা’

%d bloggers like this: