শরীরচর্চায় বাঙালী

বাঙালির শরীরচর্চা’র সুলুকসন্ধান

কিশলয় মুখোপাধ্যায় : চোদ্দ পনেরো বছরের সুদেহি কিশোর পশ্চিম থেকে ট্রেনে ফিরছে, সঙ্গেই রয়েছেন তার পিতামহ। পথের মাঝে ঠাকুরদা ট্রেন থেকে নেমেছিলেন। সেই সময় ট্রেন ছেড়ে দিলে বৃদ্ধের হতবুদ্ধি দশা। সেই ছেলেটি অবলীলায় সেই অবস্থায় ট্রেন থেকে নেমে তার ঠাকুরদাকে পাঁজাকোলা করে তুলে চলন্ত ট্রেনে উঠলেন। মুগ্ধ পিতামহ তাকে পুরস্কার স্বরূপ তৈরী করে দিলেন একটি জিমনাসিয়াম। ১৮৫৭ সালে তৈরী হ’ল প্রথম বাঙালী জিমনাসিয়াম বা আজকের পরিভাষায় যা জিম। এই গল্পের নায়ক হলেন বাংলার বিখ্যাত ব্যায়ামবিদ অম্বিকাচরণ গুহ। আর এই গল্পটি বলছিলেন তারই সুযোগ্য নাতি অপর এক বিখ্যাত মল্লবীর যতীন্দ্রচরণ গুহ ওরফে গোবরবাবু। বাঙালি দুর্বল এবং স্বাস্থ্যচর্চা করেন না এই বদনাম দূর করেছিলেন অনেক বিখ্যাত ব্যায়ামবিদ।

এই বাংলায় ব্যায়ামের জোয়ার আনেন অধুনা বাংলাদেশের বরিশালের বাসিন্দা রাজেন গুহ ঠাকুরতা। স্বাধীনতার কয়েকবছর আগে তখনকার বিখ্যাত রামমূর্তি সার্কাস বরিশালে আসে সার্কাস দেখাতে। সেই সার্কাসে দক্ষিণ ভারতীয় রামমূর্তি বুকে হাতি তুলে খেলা দেখাতেন। এবং রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানাতেন। উল্লেখ্য রাজেনবাবু সেই চ্যালেঞ্জের জবাব দিয়ে বলেছিলেন-বাংলার ঘরে ঘরে আমি হাজার রামমূর্তি তৈরী করবো। শুধু বলা নয়, তিনি কাজ শুরু করে দিলেন। রাজেন গুহ ঠাকুরতার ছাত্র ছিলেন বিষ্ণুচরণ ঘোষ, কেশব সেন, ভূপেশ কর্মকার, ললিত রায়, মনি রায়, সকুমার বোস প্রমুখরা। এদের মধ্যে সুকুমার বোস যোগাসন ও ক্যারাটেতে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেছিলেন। আর আজ সারা বাংলা জুড়ে এই যে এত ব্যায়ামাগার এর প্রসার করেছিলেন যোগাচার্য বিষ্ণুচরণ ঘোষ। তিনি ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন বিখ্যাত ঘোষেস কলেজ। রাজেন গুহ ঠাকুরতার কাছে দেহগঠনে তালিম নিলেও বিষ্ণুবাবুর মেজদা ছিলেন স্বামী যোগানন্দ। তাঁর কাছ থেকে তিনি শিক্ষা নিয়েছিলেন যোগাসনের হটযোগের ও প্রানায়ামের। দেহগঠন ও যোগাসনকে সাধারণ মানুষের উপযোগী করে তোলবার জন্য তিনি শুরু করেন নানা গবেষণা। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠা করা ব্যায়ামাগরে প্রতিনিয়ত এই বিষয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতেন। ঋষিগণের যা উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের তা নয়। সেইজন্য এই সুক্ষ তফাৎটিকে তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিবর্তন করেছিলেন, তাঁর পন্থায় মুগ্ধ হয়ে স্বামী শিবানন্দ তাঁকে ‘যোগীন্দ্র’ উপাধিতে ভূষিত করেন। দেহগঠনে বাঙালীর উল্লেখযোগ্য সাফল্য ১৯৫১ সালে লন্ডনে মনতোষ রায়ের বিশ্বশ্রী খেতাব জয়। মনতোষ রায় ছিলেন বিষ্ণুচরণ ঘোষের সুযোগ্য ছাত্র। মনতোষ রায়ের দেহে ছিলে শিল্পের ছোঁয়া, কারন তিনি ছবি আঁকতেন। তাঁর আঁকা বন্দীভারত, মুক্তভারত, অসিযোদ্ধা, ধীবর, ধনুর্ধর, কালব্যাধ, ক্রুশবিদ্ধ যিশু ইত্যাদি দেহভঙ্গীর ছবিগুলি শুধুমাত্র পেশীর আয়তেন সীমাবদ্ধ থাকে নি, লেগেছিল শিল্পের ছোঁয়াও। এর মধ্যে ১৯৪৬ সালে নিউ ইয়র্কের রচেস্টার ছবি প্রতিযোগিতায় তাঁর আঁকা ‘কালব্যাধ’ নামক ছবিটি ১৪ শত ছবির মধ্যে সর্বোত্তম ছবি বিবেচিত হয়। এবং প্রথম পুরস্কার হিসাবে ১০০০ ডলার লাভ করেন। তিনি একসময় বলেছিলেন যোগাসনই তাঁর দেহে পেলবতা আনতে সাহায্য করেছিলো। এই বছরই দ্বিতীয় হয়েছিলেন খর্বাকৃতি মনোহর আইচ। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫২ সালে তিনি এই বিভাগে প্রথম হন। এরপর ১৯৫৫ এবং ১৯৬০ সালে তিনি তৃতীয় হন। এ পর্যন্ত বাঙালি তো দূর, কোন ভারতীয় কেউই মিঃ ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় চারবার শিরোপা জেতেন নি। বিষ্ণুচরন ঘোষের আর এক ছাত্র ছিলেন কমল ভান্ডারী। তিনি সাতবার ভারত সেরার শিরোপা লাভ করেছিলেন। এছাড়াও তাঁর উল্লেখ যোগ্য ছাত্র-ছাত্রীরা হলেন-ডাঃ গৌরীশংকর মুখার্জী, শাস্তি চক্রবর্তী, রুমা বোস, রেবা রক্ষিত, হীতেন রায় প্রমুখ। বিষ্ণুবাবুও বুকে হাতি তুলতেন রামমূর্তির মতো। হাতিটির নাম ছিল ইন্দিরা।

শুধু তাঁর ছাত্ররা নন, তাঁর অন্যতম ছাত্রী রেবা রক্ষিত বুকে হাতি তুলে রেকর্ড করেছিলেন। এ বিষয়ে তিনি ১৬-১৭ বছর বয়সে যখন বুকে রোলার তুলে খেলা দেখাতেন তখন বলেছিলেন, বুকের ওপর দিয়ে রোলার কি মোটর গাড়ী চালিয়ে দেওয়া শরীরচর্চার অঙ্গ নয়, তবে এই দুঃসাহসিক কাজ দেখে অনেকেরই ভয় ভেঙ্গে যায়। মনে সাহস বাড়ে। মেয়েরা শরীরচর্চায় উদ্ভুত হয়ে নিজের ও দেশের উপকার সাধনে সক্ষম হবেন। বিষ্ণুবাবুর আরেক সুযোগ্য ছাত্রী ছিলেন লাবণ্য পালিত। ডাঃ গৌরীশংকর মুখার্জী যখন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারী পড়তে ভর্তি হয়েছিলেন, তখন তাঁর স্বাস্থ্য একবারেই ভালো ছিল না। কিন্তু বিষ্ণুচরণের সাথে আলাপ হবার পর তিনি যোগাসনে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করলেন। অন্য দিকে বিশ্বশ্রী মনতোষ রায়ের সুযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে প্রধান ছিলেন ওঙ্কারনাথ ব্যানার্জী, বিকাশ দত্ত, বিশ্বনাথ দত্ত প্রমুখ। প্রথম এশিয়াশ্রী হয়েছিলেন পরিমল দে। এছাড়াও আয়রণ ম্যান হিসাবে খ্যাত নীলমনি দাশ এবং নীরদ সরকার। সুধীর ঘটক, শচীনানন্দ শান্ত ছিলেন আয়রন ম্যান নীলমনি দাশের ছাত্র। মনতোষ রায়ের পুত্র এশিয়াশ্রী মলয় রায়, এশিয়াত্রী তুষার শীল, প্রেমসুন্দর দাস, দিব্যসুন্দর দাস প্রমুখ দেহগঠন ও যোগাসনকে বর্তমানে এগিয়ে নিয়ে চলছেন। আর এই লেখায় যার কথা উল্লেখ না করলে অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তিনি হলেন হলিউড খ্যাত বাঙালী বিখ্যাত বিক্রম চৌধুরী। তিনিও বিষ্ণুচরণ ঘোষের ছাত্র। তবে বাংলার দেহগঠনের স্বর্ণযুগ বলা যায় স্বাধীনতা লাভের ১৫-২০ বছরের সময়টা। কয়েকটা পর্যায়ে ভাগ করে দেখা যেতে পারে এই সময়টাকে। যেমন দেশ স্বাধীন হবার আগের স্বাস্থ্যচর্চা। তখন বাঙালি মূলত ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যই শরীরচর্চায় মনোনিবেশ করেছিলো। লাঠি খেলা, মুগুর ভাঁজা ইত্যাদি চলত। এরপর স্বাধীনতার পর ১৫-২০ বছর সময়টা প্রাক স্বাধীনতা মানসিকতা ছিল। মূলত এই সময় বিশ্বের দরবারে ব্যায়াম ও যোগাসনে বাঙালি রেখেছিলো প্রতিভার স্বাক্ষর। শুধুমাত্র কলকাতায় নয়, বাংলার বিভিন্ন জেলা শহরেও ব্যায়ামের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। এই সময় বাঙালি যুবকদের মধ্যে ব্যায়াম ছিল অবশ্য করণীয়। তবে এর পরের ২০ বছর বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্থিরতায় শরীর চর্চায় ভাঁটা পড়তে থাকে। ব্যতিক্রম ছিলেন কয়েকজন। আবার এই সময়ে অনেকে পাড়ার দাদাগিরি অথবা মস্তানি করার জন্য ব্যায়াম করত।

কিন্তু এখন সেসব ধারণা অতল গহ্বরে চলে গেছে। এখন চলছে ফিটনেস মন্ত্র বা ইওগা’, সিক্স প্যাক বা এইটপ্যাক বা জিরো ফিগারের যুগ। আর কিছু মানুষের ব্যায়াম করার সময়ই নেই। একটা সময় যে বাঙালি মুগুর ভাঁজত, দুটো ইট পেতে ডন দিতো, সেই বাঙালি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ঝাঁ চকচকে জিমে মন নিয়েছে, সিক্স প্যাকে আর মন লেগেছে তারা ইওগা’ তে। এখন বাঙালি টিভি দেখে শরীরচর্চা করতে বেশী অভ্যস্ত।

তবে আজ যেটার বড়ই অভাব বা তফাত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তা হ’ল ক্রমে সাধারণ ব্যায়ামাগারগুলির ঝাঁপ বন্ধ হয়ে পড়ছে। তার জায়গা পুরণ করছে আজা পাড়ায় পাড়ায় রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের বন্যানতায় গড়ে ওঠা চকচকে আধুনিক জিমনাসিয়াম বা জিম। যেখানে শরীরচর্চা বা কসরত করতে গেলে রেস্ত লাগে। তবুও বাঙালি শরীরচর্চা করছে। আগে যা ছিল সুস্থ থাকা এবং শখ, তা এখন শুধুই সুস্থতা। অতীতে বারবার ভারতশ্রী, এশিয়াশ্রী এবং বিশ্বশ্রীর মুকুট উঠেছিল বাঙালির মাথায়, এখন আধুনিক জিমে কসরত করা বাঙালি ভারতশ্রী তো দূরস্থ, পাড়াতী পর্যন্ত হয় না। তবে চলছে দেহগঠন, যা কিছুটা লোক দেখানো বলাই যায়। তবু মন্দের ভালো ব্যায়ামটাতো চলছে, চলছে ইগো বা যোগব্যায়াম। নতুন মোড়কে নতুন স্টাইলে এটাই আশার আলো।

%d