গুপ্তিপাড়ার গুঁফো

বাংলার প্রথম ব্র্যান্ডেড মিষ্টি যা নৌকাপথে পৌঁছে যেত কলকাতা তথা বাংলার আনাচেকানাচে তারই সুলুকসন্ধান করলেন সাংবাদিক আত্রেয়ী দো

প্রাচীনকাল থেকেই ভোজনরসিক বাঙ্গালির জীবনে মিষ্টি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেকোনো শুভ অনুষ্ঠান মিষ্টি ছাড়া একেবারেই অসম্পূর্ণ। আজ আপনাদের জানাব এই বাংলারই এক অতি প্রসিদ্ধ মিষ্টি যা ‘বাংলার প্রথম ব্র্যান্ডেড মিষ্টি’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার একটি সুপ্রাচীন অঞ্চল গুপ্তিপাড়া। এই বাংলার পর্যটন মানচিত্রে টেরাকোটার মন্দির সমেত বাংলার প্রথম বারোয়ারী পুজোর উত্‍পত্তিস্থল হিসেবে খ্যাত এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে গুপো বা গুঁফো সন্দেশ। এই সন্দেশটিই বাংলার প্রথম ব্র্যান্ডেড মিষ্টি নামে পরিচিত। তবে শুধু গুপ্তিপাড়াই নয় ,পানিহাটির গুপো সন্দেশও ভোজনরসিকদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়।

এই মিষ্টির নাম গুপো বা গুঁফো হল কেন?

গুপ্তিপাড়ার এই প্রসিদ্ধ মিষ্টিটির নামকরণ প্রসঙ্গে বলার আগে অঞ্চলটির নামকরণ প্রসঙ্গে আসি। এই অঞ্চলটি ছিল ধর্মচর্চার অন্যতম পীঠস্থান। পূর্বে তাই এই অঞ্চলটির নাম ছিল ‘গুপ্ত বৃন্দাবন পল্লী’। পরবর্তীকালে এর নাম হয় গুপ্তপল্লী এবং সবশেষে নাম হয় গুপ্তিপাড়া। এই গুপ্তিপাড়া অঞ্চলেই প্রথম আবির্ভাব ঘটে মাখা সন্দেশের। মাখা সন্দেশ থেকেই জন্ম নেয় এই জনপ্রিয় গুপো সন্দেশ। গুপ্তিপাড়াতে প্রথম আবির্ভাব হওয়ার দরুন এই সন্দেশের নাম হয় গুপো। পরবর্তীতে গুপো নামটি বিকৃত হয়ে নাম হয় গুঁফো সন্দেশ। তবে মতান্তরে প্রচলিত আছে যে, এই সন্দেশ খেতে গেলে গোঁফে লেগে যেত। তাই এর নাম হয় গুঁফো সন্দেশ।

ছানা পাক দিয়ে মন্ড প্রস্তুত করে, তা থেকে ছোট ছোট দুটি মন্ড নিয়ে হাত দিয়ে পাশাপাশি চেপে জুড়ে দিয়ে গোলাকৃতি এই সন্দেশটি তৈরি করা হয়। তাই এই সন্দেশের আর এক নাম ‘জোড়া সন্দেশ’।

গুপো সন্দেশের ইতিহাস –

এই সন্দেশের উৎপত্তি কবে কার হাত ধরে হয় তা সম্পর্কে বিশেষ তথ্য না পাওয়া গেলেও, শোনা যায় উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে এই সন্দেশ প্রস্তুত করা হতো। এমনকি এও শোনা যায়,১৮৫৪ সালে বাংলায় প্রথম রেলপথ চালু হওয়ার আগেই নাকি এই মিষ্টি গুপ্তিপাড়া থেকে নৌকাপথে পৌঁছে যেত কলকাতা সহ বাংলার আনাচে-কানাচে। কালক্রমে কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে এই মিষ্টির সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে পানিহাটি অঞ্চলের গুপো সন্দেশও সমান জনপ্রিয়তা লাভ করে।

এই মিষ্টি প্রস্তুত করা হয় কিভাবে?

এই সন্দেশ একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি কেবলমাত্র গরুর দুধ থেকে তৈরি ছানা দিয়েই প্রস্তুত করা হয়। এই সন্দেশের স্বাদের মূল চাবিকাঠি হল গরুর দুধ থেকে প্রস্তুত ছানা এবং খেজুর গুড়। তবে বর্তমানে গুড়ের পরিবর্তে চিনির ব্যবহারও হয়ে থাকে। গোড়ার দিকে মাখা সন্দেশ এবং গুপো সন্দেশ একই ধাঁচে প্রস্তুত করা হলেও বর্তমানে মাখা সন্দেশ এবং গুপো সন্দেশের প্রস্তুত প্রণালী তথা ছানার পাক অনেকাংশেই আলাদা। প্রথমে ছানা পাক দেওয়ার পর তা কাপড়ে মুড়ে কাঠের বারি দিয়ে ছানার অতিরিক্ত জল নিঃসরণ করা হয়। এবার সেই ছানার সাথে খেজুর গুড় অথবা চিনি মিশিয়ে মিহি সন্দেশ তৈরি করা হয়। এবার দুটি করে সন্দেশ জুড়ে তৈরি করা হয় এই গুপো বা গুঁফো সন্দেশটি।

বর্তমানে রকমারী মিষ্টির আবির্ভাবে এই সন্দেশটির জনপ্রিয়তা অনেকখানি ম্লান হয়ে গেলেও ঐতিহ্যমন্ডিত এই মিষ্টির স্বাদের খোঁজে প্রচুর মানুষ আজও গুপ্তিপাড়া ভ্রমণে করেন।

One thought on “গুপ্তিপাড়ার গুঁফো

Comments are closed.

%d