চিতার আগুন মাথা নত করে দাঁড়িয়ে

আমরা কদিন আগেই হরিয়েছি ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের প্রথম লিটিল ম্যাগাজিন লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠাতা সন্দীপ দত্তকে। সাহিত্যপ্রেমী মহান এই মানুষটিকে নিয়ে সংবাদ প্রতিখনে স্মৃতিচারণায় কবি লেখক এবং সাহিত্যনুরাগী দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

জার্মান দার্শনিক ও কবি Goethe তার মৃত্যু শয্যায় বলেছিলেন “More light,more light”। কলেজ স্কোয়ারে সাদা চাদর ঢাকা দেহটার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল ,শেষ কি কথা বলে গেলেন সন্দীপদা?  লিটল ম্যাগাজিনের আকাশ, আমাদের ভরসার রঙীন আশ্রয়  হয়তো বলে উঠেছিলেন “More light for lit mags,more light for lit mags “। আরো আরো, আরো প্রাণ দাও ঈশ্বর লিটিল ম্যাগাজিনের পৃথিবী জুড়ে ! একটা হৃদয় মোচড়ানো দুঃখ ওনার শায়িত শরীরের মুখটার দিকে তাকিয়ে।যেন মনে হচ্ছিল এক্ষুণি উঠে বসে বলে উঠবেন, ” বোলো, কি খবর তোমার?”  মুখের সেই প্রাণজাগানো হাসি ,চোখের বিদ্যুৎ আর থাকবে না। সত্যিই কি থাকবে না ?

কে প্রথম কাছে এসেছি, আজ আর সেইভাবে মনে নেই। টুকরো টুকরো স্মৃতির মালা বুক জুড়ে। সময়ের বিনুনি বুকের হৃদয় ছুঁয়ে ছিল ওনারই ঋদ্ধতার সৌমনস্যতায়।

মনে পড়ে সেদিন কৃষ্ণপদ মেমোরিয়াল হলে একটা পত্রিকার কবিতা পাঠের আসরে কবিতা পাঠ করে নেমে আসছি।হলের হাততালির আওয়াজ বুঝিয়ে দিয়েছে ভালোলাগার কথা। সন্দীপ দত্ত প্রধান অতিথির আসনে। আমার হাতে মেমেন্টো তুলে দেওয়ার সময় মুচকি হেসে হঠাৎ কানের কাছে মুখটা এনে বলে উঠেছিলেন ,” মনের ঘরে বাঁধলে বাসর/ বাহির তোমার প্রিয় রে!”চমকে উঠেছিলাম। কি বলতে চাইলেন? কেনই বা? একটা ঘোরলাগা অনুভব নিয়ে বাড়ি ফেরা। রাতে ফোন করলে বললেন -“কবিতাটা ভালো। তবে আরো গভীরে যাও। ভেঙ্গে ফেলো টুকরো টুকরো করে।তবেই না মজা। “ফোন রেখে মনকে বলে উঠলাম,পাগলা, মনটাকে তুই ভাঙ। এরকম ছিলেন সন্দীপ দত্ত। ছোট্ট কথায় লেখকের হাওয়া মোরগ। বড়ো মায়ার হাসিতে ভেজা, জাগনপাগল।

বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন হলে ওনার সাথে দেখা হলেই একটা কথা জিজ্ঞাসার তালিকায় অবশ্যই থাকতো, লিখছো তো?  লেখো। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ মুখুজ্জ্যের সাথে আলাপ ‘ কবিতার শেষ লাইনটা তখন মনের ভেতর -“মুখুজ্জ্যে, তুমি লেখো।”

আমার অভিজ্ঞতা প্রায় সকল লেখকেরই। সকলের লেখা পড়ার চেষ্টা করতেন। বিশেষতঃ নবীনদের।উৎসাহ দিতেন অভিভাবকের মতো।এমন একটা সম্পর্কের বলয় তৈরি হয়ে যেতো যে লেখকও ভরসার আশ্রয় খুঁজে পেতো অচিরেই।লাখ ছুঁই ছুঁই লিটিল ম্যাগাজিনের যেন এক জীবন্ত Database।

দুবার যাওয়া ওনার লাইব্রেরী ও গবেষণাগারে। প্রথম বার গিয়ে একটু মৃদু বকুনি খেয়েছিলাম।’ তবুও একলব্য’ পত্রিকায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ওপর একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। উনি ঠিক পড়ে ছিলেন। শুরুতে দুচার কথা বলার পর সেই ধমক আমার অভিভাবকের গলায় “আমার এখানে বিদ্যাসাগরের ওপর এতো লেখা ছিল , একবার আসতে পারলে না! “আসলে সময় কম ছিল, তাই উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি থেকেই কাজ মিটে গেছিল। শুনে মুচকি হেসে বললেন, পরের বার কিছু লিখতে গেলে এখানে এসো। অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়েছিল সেদিন। কেমন একটা ঘোরলাগা। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এসেছিল মহান মানুষটার জন্য। ঈশ্বরকে মনে মনে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম যে সন্দীপদার মতো বনস্পতির ছায়ায় আসতে পেরেছি বলে। পরে অনেক বন্ধু স্থানীয় লেখকের সাথে কথা বলে জেনেছিলাম,  সকলেরই একই অভিজ্ঞতা। ওনার কাছে দ্বিতীয় বার যাওয়া সত্যজিৎ রায়ের ওপর একটা লেখা তৈরির সময়।বলতেই অবলীলায় এদিক ওদিক হাত বাড়িয়ে চারটি বই বার করে দিলেন। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা সেদিন দেখলাম। ওনার সারা মাথা জুড়ে শুধু বইবাসা।।

অদ্ভুত সব কথা বলতেন দাদা। কবিতা লিখতে গেলে স্বপ্ন দেখো,  নিজেকে ভেঙ্গে যাও পরতে পরতে। সেই ভাঙ্গা থেকেই বেরিয়ে আসবে নতুন ধ্বনি, শব্দ। এটা একটা ধারা, আবিস্কারের প্রবাহ বলতে পারো। থেমে থেমে যখন কথা গুলো বলতেন তখন প্রত্যেক শব্দ যেন গভীরতা থেকে উঠে আসছে,  বোঝা যেত। Australiaর Apteryx পাখির ডানা ক্রমে ছোট হয়ে যায়। আমাদের স্বপ্ন দেখার ডানাও যেন ছোট হয়ে আসছে, বলেছিলেন সেদিন। ভাবনার পরিধি যেন সঙ্কুচিত হয়ে না পড়ে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে বলেছিলেন। প্রাত্যহিকীর মধ্যেই লেখার রসদ একজন লেখক খুঁজে নেন।মানুষই তখন লেখকের  একাধারে আধার ও আধেয়।মনে মনে সেদিন জেগে উঠেছিলাম ওনার কথা শুনে।পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ ছিন্নপত্র’ পড়তে গিয়ে দেখি কবির ভাবনাও এক ছিল। সেখানেও কবির আফশোস। স্বপ্নের খোলসেই আসল ঋদ্ধি।

একজন কবির দর্শন কেমন হবে? ঋদ্ধ মানুষটার কাছে প্রশ্নটা রাখলেই সেই হাসি মুখ। অদ্ভুত এক দর্শন বেরিয়ে এলো। অক্টাভিও পাজের এক উদ্ধৃতি দিলেন, ” একটা কবিতা পড়া মানে সেটি চোখ দিয়ে শোনা,একটি কবিতা শোনা মানে সেটি কান দিয়ে দেখা।” নাড়িয়ে দেওয়া অনুভব। আমার চোখের তারায় কিছু যেন খোঁজার চেষ্টা করছেন। বুঝলাম,এক্স রে মেশিনের নিচে আমি এখন। হঠাৎ বলে উঠলেন, পৃথিবীর সৌন্দর্য যে দেখতে পায় না পৃথিবী তার কাছে “মৃৎপিন্ডো জলরেখয়া বলয়িত:”।এই জলরেখা বলয়িত মৃৎপিন্ডের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আসল কবিতার সুর। প্রকৃতির সাথে আলিপ্ত অনুভবই রূপান্তরিত হয় কবিতায়।

চোখ কান হৃদয় দিয়ে এর রূপ রস গন্ধ নাও।লেখো প্রকৃতিরই জারণে। এই অনুভবই রোপন করতেন লেখকদের বুকে বুকে। কতো লেখককে দেখেছি কতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ওনার শরণাপন্ন হতে। এককথায় উনি যেন বিপদ তাড়ণ। কি অদ্ভুত ধৈর্য নিয়ে সকলকে সাহায্য করতেন। ঠোঁট ভেজা থাকতো সেই হীরক হাসি। সকলকে যেন বনস্পতির ছায়া দিয়ে গেলেন তার ঋদ্ধতায়। ওনার কাছে কাটিয়ে আসা প্রতিটা মুহূর্তই তাই আমার কলম সেবধি।

একদিন আলোচনায় হঠাৎ উপনিষদের উদ্ধৃতি -“উদ্ধরেত আত্মনা আত্মানম্”। মানে, আমি আমাকে উদ্ধার করতে পারি,অন্যদের পারি কি!

আবার সেই গভীর অনুভবের মুর্ছনা। দুচোখে যেন অন্তর-অন্বেষণ! বলে উঠলেন, কবিতাই পারে পাঠককে দুঃখ কষ্টের বোধ থেকে কিছুটা উদ্ধার করতে। কবিতাই পারে গ্লানিমার খোলস ছিঁড়ে পাঠককে দিতে প্রজাপতির উড়ান। স্তব্ধ নির্বাক আমি শুধু বসে বসে প্রার্থনা করতাম,ঘড়ির কাঁটা আজ থেমে যাক,সময় রকে বসে থাক সব ভুলে আরও কিছুক্ষণ।

তর্কও চলতো দুজনের। মালার্মে দেগাসকে একবার উপদেশ দিয়েছিলেন – “One makes poetry with words, not with ideas “। শব্দ দিয়ে কাব্য রচনা করতে হয়,ভাব দিয়ে নয়।খটকা লাগতো আমার।অথচ রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছেন,কবিতায় একটা suggestiveness থাকবে , শুধু খটখটে শব্দের ঝঙ্কার হবে না।বোধ উন্মোচন ! সন্দীপদাকে  বিষয়টা নিয়ে খোঁচালেই বেরিয়ে আসতো ভাবের আলপনা।বলতেন , শব্দ থাকুক, কিন্তু কবিতার প্রাণ হলো ভাব। যেকোন লেখাতেই লেখক পাঠককে হাত ধরে পথ দেখান।পথ শেষ হলে পাঠক মনে মনে ঠিক করে নেন পথটা কেমন ছিল-মসৃণ, পিচ্ছিল, কর্দমাক্ত না বন্ধুর। পাঠক কবির অক্ষরেখায় বিরাজ করতে নাও পারেন। অন্য ভাব খুঁজে পেতে পারেন। কিন্তু একটা বোধ থাকবে। থেমে থেমে অল্প কথায় কতো কথা বলে দিতেন। সকলের মতোই সন্দীপদা বিমুগ্ধ বিস্ময় তাই আমার কাছে।

উনি বলতেন,একটা কবিতায় কিছু কিছু শব্দ বা লাইন কবিতাটাকে টেনে নিয়ে যায় পাঠকের হৃদয় থেকে হৃদয়ে।অমর হয়ে উঠেন কবি। কবিতার ঐন্দ্রজালিক শব্দ সম্পর্কে সাত্র বলেছেন -“It’s sonority, it’s masculine endings, it’s vistual aspect compose for him a face of fresh”। স্মার্ট ঝকঝকে দর্শন প্রতিটা লেখকের কাছেই পাথেয় হয়ে ওঠে। সন্দীপদার সঙ্গে কয়েক ঘন্টার আলোচনা এইরকম ভাবে সাজিয়ে দিয়ে যেত সকলকে।

লিটিল ম্যাগাজিনের প্রাণপুরুষ বহু পুরস্কারে ভূষিত মানুষটার সহজ সর‌ল ব্যবহার ও প্রাণঢেলে লেখকদের সাহায্য করার আপ্রাণ চেষ্টা তাকে শ্রদ্ধায় স্মরণে রাখবেই সবাকার কাছে। একটা বটগাছ ছিলেন। করোনা কালে ওনাকে ফোন করতাম। কখনো কথা হোতো, কখনো হতো না। অনেক বিষয়ে লিখতে গিয়ে দ্বিধা এলেই হাতের আঙ্গুল অজান্তেই ওনার নম্বর ছুঁয়ে ফেলতো। কখনো বিরক্ত হতে দেখিনি। তবে শারীরিক কারণে শেষের দিকে একটু চুপ থাকতে চাইতেন।বুঝতাম সব। ভেতরে ভেতরে ওনার লড়াই ছুঁয়ে যেত।

জার্মান কবি Goethe এর কথাটা মনে পড়ে–“Entbehren sollst du, sollst Entbehren”

মানে, ” Thou must do without ,must do without “। বাইরের সমস্ত যখন বিরল,তখনি নিজেকে ভালোরকমে পাওয়া যায়। সন্দীপদার স্মৃতি,  তার সখ্যতা তাই ভেতর ঘরে প্রদীপ জ্বালায় প্রতি সাঁঝে। জেগে থাকা রাতে তারারা আমার বিছানায় গল্প শুনতে নেমে এলে সন্দীপদার দর্শন তাদেরও সঙ্গী হয়। আমার নিশিযাপনের সাক্ষী হয়ে থাকেন দাদা তখন। বাইরের কলুষতা, কদর্যতা,  অবিশ্বাস,  দ্বিচারিতার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে যখন ভেতর ঘরের চৌকাঠে এসে দাঁড়াই আমরা,জানি তখন সন্দীপদা  আসেন তার ভালোবাসার মানুষদের ঘরে আপন মহিমায়।

কবিগুরুর গান গাইতে গাইতে শোক মিছিল যখন এগিয়ে চলেছে চেনা পথ ফেলে রেখে, ” সন্দীপ দত্ত অমর রহে” মন বলে উঠলো।

পথের দুপাশের উৎসুক মুখে শুধু শ্রদ্ধা দেখেছি সেদিন। অগণিত জনতার প্রণাম ছুঁয়ে যাচ্ছে তার বহু পথ হাঁটা পা।দাড়ির আবরণ ভেদ করে সকলের চোখের শ্রদ্ধা ছুঁয়ে যাচ্ছে তার মুখ।সকলের চোখেমুখে একটাই প্রার্থনা,  একটাই আকুতি–একবার, শুধু একবার নয়ন মেলে দ্যাখো। দ্যাখো তোমার আবেগ, লড়াই কতো হৃদয় ছুঁয়ে। তোমার অভিভাবকত্বের আকর কতো চোখের জলে সিক্ত। একবার, শুধু একবার !

ওনার বাড়ি থেকে শেষবার চলে আসার সময়, “আবার আসবো”বললে, উনি মুচকি হেসে বলে উঠেছিলেন গুরুদেবের কথায় –

“আমি নিশিদিন হেথা বসে আছি,

তোমার যখন মনে পড়ে আসিয়ো ।”

মনে তো পড়ছে আপনাকে। ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে আপনার সামনে বসতে। কিন্তু..

তৃষিত পৃথিবীর বুকে বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা পড়লে যে সোঁদা গন্ধ বের হয় ,তার কারণ অ্যাকটিনোমাইসেটিস নামের এক ব্যাকটেরিয়া।

লিটিল ম্যাগাজিন হলো সেই অ্যাকটিনোমাইসেটিস যা সাহিত্যের মূল ধারার জোগান স্রোতকে সোঁদা গন্ধে ভরিয়ে দেয়।এই ধারাকে বাঁচার নতুন দিশা দিয়েছিলেন সন্দীপ দত্ত।

আলবেয়ার কামু একবার বলেছিলেন ,”আমার পিছু পিছু হাঁটবেন না, আমি নেতৃত্ব না-ই দিতে পারি। আমার আগে আগে হাঁটবেন না, আমি অনুসরণ নাও করতে পারি। শুধু আমার পাশে হাঁটুন, আমার বন্ধু হয়ে উঠুন। “কামুর কথাটাই যেন ছিল সন্দীপদার মনের কথা। প্রচারবিমুখ মানুষটি শুধু মানুষকে পাশে নিয়ে লড়তে চেয়েছিলেন। যে আগুনটা জ্বালিয়েছিলেন তা আজ প্রায় প্রতিটা লেখককে ছুঁয়েছে।তাই সন্দীপ দত্ত থেকে যাবেন ওনারই তৈরি লড়াইয়ের আগুনে, ওনারই ঋদ্ধতার সিংহাসনে।

প্রতিটা দিন তাই হয়ে উঠুক লিটিল ম্যাগাজিন দিবস।

আজ “উনি নেই” শুনলেই অবরুদ্ধ কন্ঠ নির্গত কান্না আকাশ বাতাস ধ্বনিত-প্রতিধবনিত করে যেন বলে উঠতে চাইছে–

“এই কথা সদা শুনি, “গেছে চলে, গেছে চলে”

তবু রাখি বলে

বোলো না “সে নাই”।

One thought on “চিতার আগুন মাথা নত করে দাঁড়িয়ে

Comments are closed.

%d bloggers like this: