আজকের পর্বে হুগলি জেলার অন্যতম প্রাচীন জনপদ চণ্ডীতলার অন্তর্গত বোরিজহাটির মেজ মহাশয়ের বাড়ি বা চৌধুরীবাড়ির ৩০০ অতিক্রান্ত প্রাচীন দুর্গা পুজো সম্পর্কে আলোকপাত করলেন সংবাদ প্রতিখনের সহকারী সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমান
হুগলি জেলার অন্যতম এক বর্ধিষ্ণু গ্র্রাম চণ্ডীতলা ব্লকের অন্তর্গত বোরিজহাটি। আর এই বোরিজহাটি গ্রামের ৩০০ বছর অতিক্রম করে আজও স্ব-মহিমায় পূজিত হয়ে চলেছেন দশভুজা, দনুজদলনী, মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গা এই গ্রামের এক সময়ের জমিদারবাড়ি চৌধুরীবাড়িতে (মেজ মহাশয়ের বাড়ি)। যে বাড়ির পুজোকে কেন্দ্র করে আজও স্থানীয় সকলের উত্সাহ ও উদ্দীপনার অন্ত নেই। আজও এই বাড়ির পুজোয় প্রতিদিনই নিষ্ঠা সহকারে মা’র পুজো হয়ে চলেছে সকল রীতি-নীতি, নিয়ম মেনে। বর্তমান সময় যখন সমস্ত কিছুই আধুনিকতার মোড়কে পরিবেশিত হচ্ছে, যখন সেই অতি আধুনিকতার মোড়কে নিজেদের সাজিয়ে নিতে আমাদের রাজ্যের বেশ কিছু বনেদি বাড়িও বাদ নেই, তারাও যখন আধুনিকতার নাগপাশে নিজেদের আবদ্ধ করে তাঁদের বাড়ির সুপ্রাচীন পুজোকে করে তুলেছেন তাঁদের বিপননের হাতিয়ার।
ঠিক সেই মূহুর্তে অবস্থান করেও আজও আমাদের এই পশ্চিমবাংলার গ্রামের অধিকাংশ বনেদি বাড়িগুলি মেতে ওঠেন নিজেদের বাড়ির পুজোর সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে রক্ষা করে দেবীকে আরাধনা করতে। এই ভাবেই হুগলি জেলার বোরিজহাটি গ্রামের চৌধুরীদের বাড়ির পুজোয় আজও সেই প্রাচীন রীতি মেনেই পূজিত হচ্ছেন দেবী দুর্গা। অবাক লাগে যখন শোনা যায় এই বাড়ির পুজোয় আজও বাড়ির সকল পুরুষ মিলে ঠাকুরের তিন দিনের সকল ভোগ রান্না করেন এবং পুজোর যাবতীয় কাজ আনন্দের সঙ্গে করেন।
এর সঙ্গে যে বিষয়টি আমাদের বিশেষ আন্দোলিত করে সেটি হল এই চৌধুরী বাড়িতে দুর্গা পুজোয় সপ্তমী, অষ্টমী আর নবমী এই তিনদিনই সারা গ্রাম সমেত আশপাশের নানা গ্রাম থেকে জাতি-ধর্ম, বড়-ছোট, ধনী-দরিদ্র এক হয়ে এক পংক্তিতে বসে ঠাকুরের ভোগ প্রসাদ গ্রহণ করেন। প্রতিদিন প্রায় ৪০০’র বেশি মানুষ এই বাড়তে প্রসাদ গ্রহণ করেন। এই বাড়ির পুজোর নানা পদ্ধতি ও নানান নিয়ম ও যাবতীয় খুটিনাটি বিষয় সম্পর্কে এই বাড়ির অন্যতম সদস্যা গৌরী চৌধুরী (৭৬ বছর) জানাচ্ছিলেন নানা অজানা কথা এই বাড়ির পুজো সম্পর্কে।
তিনি জানান তাঁদের বাড়ির পূজোয় প্রায় ৮০ কেজি চালের নৈবেদ্য করে মাকে অর্পণ করা হয়। এছাড়াও এই বাড়ির পুজোয় তিনদিন ছাগ বলি আবশ্যক। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য সন্ধি পুজোর সময়ে যে ছাগ বলি দেওয়া হয় সেটিকে অতি অবশ্যই পুরোপুরি কালো রঙের হতে হবে। এছাড়াও সন্ধি পুজোয় ১৭ কেজি কামিনী আতপ চালের নৈবেদ্য করা হয়। ছাগ বলি অন্যান্য ফলমূল বলির প্রথাও রয়েছে এই বাড়িতে।
দেবী দুর্গার সুপ্রাচীন কাঠামোকে রথের দিন ধুমধাম সহকারে পুজো করে সেই বছরের পুজোর শুভ সুচনা হয় চৌধুরী বাড়িতে। সপ্তমী তিথিতে কলাবউকে বাড়ির ছেলের মাথায় করে স্থানীয় সরস্বতী নদীতে স্নান করিয়ে এনে আবার পুজোস্থলে শিশির জল, বৃষ্টির জল, গরম জল, পদ্ম জল ইত্যাদি নানা রকম জলে নবপত্রিকাকে স্নান করিয়ে মন্ডপে তোলা হয়। আজও দেবীর বিসর্জনের সময়ে ঢাক ঢোল বাজিয়ে বাড়ির পুরুষেরা দেবীকে কাঁধে করে নিয়ে সরস্বতী নদীতে বিসর্জন করেন। এখনও এই রকম নানা রীতিনীতির দর্শন মেলে আমাদের গ্রাম বাংলার প্রাচীন বাড়িগুলির পুজোতে, যা একসময়ে ছিল আমাদের ঐতিহ্য।