‘দেবদত্তা’ একটি লড়াই

Untitled-1স্বরূপম চক্রবর্তী: “এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।” আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এই রকম মানুষের আজ বড়ই প্রয়োজন, যাঁরা প্রকৃতই নিজেদের জীবনকে বাজী রেখে প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলেছেন এই সমাজের নানা ব্যাধি পরিষ্কার করতে। যাঁরা নিজেদের ঘর-সংসার, আত্মীয়-পরিজন, পুত্র-কন্যা সকলকে ভুলে নিজের নিজের কর্তব্যে অবিচল থেকে আমাদের সমাজকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর, তাঁদের নিজেদেরই আজ  অবস্থাটা কি আমরা একবারও ভেবে দেখেছি বা দেখার চেষ্টা করেছি? আসলে আমরা সাধারণ মানুষের দল কিছুটা এই রকমই, আমর খুব সহজেই সকলকিছুই ভুলে যাই বা সেভাবে ভাবি না সেই বিষয়গুলি নিয়ে। আমাদের প্রশাসনের মাথায় যে সকল মানুষজন বসে রয়েছেন; বর্তমান সময়ে তাঁদের দূরবস্থা বা তাঁদের কাজ করবার সম্পর্কে আমরা নিজেরা অর্থাত্‍ আমপাবলিক কতটা উত্‍সুক, আমরা কতটা খোঁজ রাখি তাঁদের, শুধু জানি তাঁর তাঁদের কাজের বিনিময়ে সরকার বাহাদুরের কাছ থেকে মাস গেলে একটি ভাল মইনের প্যাকেজ পান। আসলে আমাদের সমানে অকস্মাত্‍ ঘটে যাওয়া এমন কিছু কিছু ঘটনা মাঝে মাঝেই আমদের নাড়িয়ে দেয়, আমাদের ভাবিয়ে তোলে, আমরা নিজেরা কতটা স্বার্থপর, কারণ আমরা শুধুই নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। এই মূহুর্তে সারা দেশে সামনের সারিতে থেকে ভয়ংকর অতিমারীর বিরুদ্ধে নিজেদের প্রাণ বাজি রেখে যে সকল মানুষগুলি লড়াই করে চলেছেন, তাঁর কি অবস্থায়, কি পরিস্থিতিতে নিজেদের কাজ করে চলেছেন আগামীতে আপামর জনতা যাতে একটি সুন্দর সকল উপহার পায়। গতকালের (১৩ জুলাই ২০২০) একটি খবর আমাদের অনেকেরই হৃদয়কে কিছুটা হলেও উদ্বেলিত করেছে, সংবাদটি সম্পর্কে আপনার প্রত্যেকেই ওয়াকিবহল। জীবনের মাত্র ৩৮টা বসন্ত পেরিয়ে ভয়ঙ্কর মারণ ভাইরাস করোনার সঙ্গে একেবারে সামনের সারিতে থেকে লড়াই করতে করতে নিজেই করোনাতেই আক্রান্ত হয়ে অকালে চলে গেলেন হুগলি জেলার চন্দননগরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর দেবদত্তা রায়। যাঁর যুদ্ধটা সীমাবদ্ধ ছিল না তাঁর কর্মক্ষেত্রের চার দেওয়ালের মধ্যে, তাঁকে লড়তে হয়েছিল লড়াইয়ের ময্ত্‍দানে নেমে সরাসরি। আসলে ওই যে কথা দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম, আবারও সেই বিষয়েই ফিরতে আসতে হচ্ছে, এই সময়ে একেবারে সামনের সারি থেকে ডাক্তার, নার্স, পুলিশ সকলে মিলে করোনা যুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন, যে আমরা সহজেই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু একবারও ভাবছি কি বা কোনদিন কিচ্ছুক্ষনের জন্য হলেও চিন্তা করেছি কি আমাদের দেশের ও রাজ্যের প্রশাসনের সেই সকল প্রশাসনিক কর্তাদের বিষয়ে, তাঁরাও কিন্তু এই অসম যুদ্ধে ঢাল-তলোয়ার বিহীন নিধিরাম সর্দার হয়ে লড়াই করে চলেছেন প্রতিনিয়ত আমাদের সাধারণ মানুষের জন্য। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানো বা হাসপাতালে বা কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পাঠানো অথবা আম্ফানের পর ত্রাণ কার্য পরিচালনা, সকল কাজগুলিকেই প্রশাসনের এই সকল কর্তারা সদা অবিচল। কখনও কি ভেবেছি এই সকল প্রশাসনিক কর্তারা এই ভাবে ক্রমশঃ নিজেদের জীবনে নিয়ে আসছেন নানা রোগ, না হলে গতকাল আমাদের রাজ্যের যে প্রশাসনিক কর্তাকে আমরা অকালে হারালাম, তিনি নিজেও কি ভেবেছিলেন তাঁর অন্তিম পরিনীতির কথা! সমবেদনা নয়, প্রয়োজন সঠিক পরিকাঠামোর। না হলে আরও কত কৃতী মানুষদের আমরা আগামীতে হারিয়ে ফেলবো সে কথা ভাববার সময় কি হয় নি এখনো? যিনি চলে গেলেন তাঁকে নিয়ে আগামীতে অনেক লেখা হবে, অনেক সভা সমিতিতে ওনার কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করা হবে; কবির ভাষায় বলতে গেলে বলা ভাল “কত প্রশংসা, কত কবিতা……., বিশেষনের পর বিশেষণ, টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পড় মেরে”। আসলে এটাই বাস্তব। একটার পর একটা ঘটনা আমাদের জীবনের রঙ্গমঞ্চে ঘটে চলে আমাদের জীবনচক্রে, কিন্তু তা থেকে আমরা কতটা শিক্ষা নিতে পারি? বা নিচ্ছি আমাদের চলার পথে?

%d bloggers like this: