গোপা ব্যানার্জী, চুরুলিয়াঃ দিগন্তছুঁয়ে থাকা কালো পাহাড়ের পাদদেশে ঐতিহাসিক চুরুলিয়া, যে চুরুলিয়া আমাদের দিয়েছে নিজেদের মতো করে বাঁচতে, এই চুরুলিয়ার সেই মহান সন্তানের জন্যই আজ আমরা নারীরা অন্তঃপুরবাসিনী হিসাবে নিজেদের আবদ্ধ করে না রেখে মেলে দিতে পেরেছি বিপুল এই পৃথিবীর বুকে, শত বাধা-বিপত্তিকে হেলায় অতিক্রম করে হাতে তুলে নিতে সক্ষম হয়েছি কলম। তাই বিদ্রোহী কবির সেই লাইন গুলি আজও আমার হৃদ-মাঝারে দোলা দেয় অনবরত। নিজেকে চার দেওয়াল থেকে মুক্ত করে মন ছুটে চলে জগৎ পানে। আমার প্রিয় কবিকে তাঁর জন্মস্থানে শ্রদ্ধা জানানোর এক অভূতপূর্ব সুযোগের অসদব্যবহার না করে গুটি গুটি পায়ে এসে হাজির হলাম কালো হীরার দেশ আসানসোলের ১৩ কিমি দূরে কবির জন্মস্থান চুরুলিয়ায়।
আসলে কবির নাতনী সোনালী কাজীর আন্তরিক আহ্বানের উপেক্ষা না করে চুরুলিয়ায় পৌঁছে আজ আমি ধন্য। চুরুলিয়ার মাটিতে নতমস্তক হয়ে অন্তরের শ্রদ্ধা ও নমস্কার জানালাম বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ওরফে দূখু মিঞাকে। ‘দুখুর চুরুলিয়া’ ভাবতেই শিহরণ লাগল শিরায়। মনের আবেগ বেরিয়ে এলো দুচোখ বেয়ে। ভাষা হারিয়ে ফেলেছি চুরুলিয়ার বুকে পা রেখে।
১১ জ্যেষ্ঠ বললেই যার কথা প্রথম মনে আসে তিনি হলেন আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। চারিদিক মুখরিত কবির গান, কবিতায়। কবির নাতনি সোনালী কাজীর ডাকে আমি অতি সামান্য একজন কবি সুযোগ পেয়েছি বাংলাদেশের জাতীয় কবি, এপার বাংলা, ওপার বাংলার ঘরের কবি নজরুল ইসলামের ১২০ তম জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানতে স্বরচিত কবিতা পাঠের মাধ্যমে, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। এবছর কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯২২ সালের ১২আগস্ট নব ধূমকেতু পত্রিকা যেটি কবির নিজের প্রকাশ করা; তা আবার নতুন ভাবে নতুন রূপে প্রকাশ পেল চুরুলিয়ার মাটিতে। বাংলাদেশের স্বনাম ধন্য কবি, সম্পাদক ও প্রকাশক শাহনেওয়াজ পারভীন শান্তি মহাশয়ার সঙ্গে আলাপ করে অন্য ভাবে নিজেকে চিনলাম আমি। জানলাম উনি এই প্রথম কবির জন্মদিনে কবির ভিটাতে এসেছেন। ওনার মুখে বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে কবিকে নিয়ে যে উচ্ছাস, যে আবেগ তা শুনতে শুনতে নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম বারে বারে। এই অনুষ্ঠানটির পেছনে দাঁড়িয়ে যে সকল মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাইরে থেকে আসা মানুষদের প্রতিদিন চারবেলা মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন এই প্রচণ্ড দাবদাহে দগ্ধ হয়েও হাসি মুখে শয়ে শয়ে মানুষকে আন্তরিকতার সঙ্গে, তা আমরা শহুরে সভ্যতার আধুনিক মানুষরা কল্পনাও করতে পারি না।
চুরুলিয়ার গ্রামবাসীরা নিজেরাই এই বৃহৎ কর্মকাণ্ডটি নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, শ্রদ্ধায় মাথা নিচু হয়ে যায় ওইসকল গ্রামবাসীদের জন্য। মন না চাইলেও অনেক কাজ করতে আমরা বাধ্য হই, মন চাইছিল নিজেকে মিশিয়ে দিই গ্রামের ওই সরল আন্তরিক মানুষগুলির সঙ্গে যাঁরা তাদের প্রিয় কবিকে সম্মান জানতে উজাড় করে দিয়েছেন নিজেদের, কিন্তু আমরা সকলেই এমন শৃঙ্খলে আবদ্ধ তার থেকে মুক্তি কোথায় আমাদের। তাইতো ফিরতে না চাইলেও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম আমাদের আধুনিক সভ্যতার মেকী মোড়কে মোড়া তিলোত্তমার পানে। কানে ভেসে আসছে “থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎ টা কে”। আর মননে রইল প্রার্থনা-“হে প্রাণের কবি, আরো একবার ফিরে এসো তোমার এই মাতৃভূমি তে, বর্তমানের এই ঘুণ ধরা সমাজের সকল শৃঙ্খল মুক্ত করতে।