সদা হাস্যময়, সদালাপী, সংবাদ প্রতিখনের অন্যতম প্রধান শুভানুধ্যায়ী প্রফেসর তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ । তাঁর স্মৃতিতে আমাদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন
স্বরূপম চক্রবর্তী : ভাবতেই পারি না তোমাকে ছাড়া। একটা সময় ছিল যখন আমরা অসম বয়সী দুজনে নানা গল্প-কথায়, আলাপ-আলোচনায়, তর্কে-বিতর্কে নিজেদের মাতিয়ে রাখতাম। ভাবনা-চিন্তা চলত কিভাবে, কোন পথে চললে আমরা আমাদের সঠিক লক্ষে পৌঁছতে সক্ষম হব। চলছিলও সবকিছু নিয়ম মেনেই, সহসা সবকিছু তোলপাড় করে আসা একটা বিকাল কখন যে তোমাকে আমাদের সকলের থেকে একেবারে অন্য এক অচিনপুরে নিয়ে পাড়ি জমালো তা আজও শুধুই ভেবেই চলেছি। ভাবছি এখনো হয়ত বা বেজে উঠবে আমার হাতের মুঠোফোন, বলবে তুমি-‘কোথায় আছিস, পারলে একবার চলে আয় কথা আছে।’ মনে পড়ে তোমার? তুমি, আমি আরও কয়েকজন মিলে চায়ের দোকানের সেই আড্ডার আসর। যে আড্ডা ছিল না শুধুই নিছক সময় কাটানোর আড্ডা। যে আড্ডা ছিল আমাদের প্রানের, মনের তথা অন্তরের ও জ্ঞানের বিকাশের আড্ডা। তা আজ আর কোথায় পাই? এখনো খুঁজে বেড়াই সেইরকম এক আড্ডার। যেখানে রাজনীতি থাকবে কিন্তু সেটা বাস্তবের ওপর ভিত্তি করে, যেখানে সুস্থ সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে নিজেদের সদর্থক ভূমিকা থাকবে, যে আড্ডা থেকে জন্ম নেবে তোমার অন্তরের রতন চাচারা। ভেবে অবাক হই আজও শিক্ষকতা অনেকেই করে, কিন্তু তুমি ছিলে প্রকৃত আদর্শ শিক্ষক। হয়ত নিজের কাজের স্বীকৃতি তুমি পাওনি কোনওদিন, হয়ত কেন বলছি পাওনি বলাটাই শ্রেয়। কেউই তোমাকে মনে রাখেনি, বিশেষ করে যারা তোমার কাছে কোনও না কোন ভাবে সামান্য হলেই উপকৃত হয়েছিলেন। আসলে তুমি তো কোনওদিনই সাদাকে কালো বা কালোকে সাদা করে দেখাও নি বা দেখো নি। রুক্ষ লাল মাটির আদিবাসী মানুষগুলি ছিল তোমার খুব কাছের। তাইতো রতন চাচার কলমে বারে বারেই উঠে আসতো তাদের অন্তরের বেদনার-সুখ-দুঃখের কথা ছন্দ হয়ে।
কোনও এক অমোঘ টানে বারেবারেই ছুটে যেতে প্রকৃতির কোলে নিজেকে মেলে দিতে। বঙ্গ সংস্কৃতির প্রতি তোমার অনুরাগ সেই ছোট্ট থেকে তোমার প্রতি আমার প্রেম আরও বেশি করে জাগিয়ে তুলেছিল। ভাবতাম তুমি কি করে এত কিছু একাহাতে সুচারুরুপে সম্পন্ন করো! আজ যখন একান্তে নিজেদের এই ক্ষয়িষ্ণু-ঘূন ধরা সমাজের দিকে তাকাই, তখন ভাবি তুমি থাকলে আজ তোমার কলম গর্জে উঠত এই সকল সমাজের ভন্ড সংস্কৃতির ব্যবসাদারদের বিরুদ্ধে। আজকে হয়ত তুমি আড়াল থেকে সব দেখছো আর মুচকি মুচকি হাসছো।
সাতটা বছর পেরিয়ে এলাম; তোমাকে তো কই ভুলতে পারলাম না। এটাকে কি বলা যায়, তোমার প্রতি আমার অন্তরের শ্রদ্ধা, নাকি অন্য কিছু? ‘যোগাযোগ’ থেকে তোমার আমার আত্মিক যোগাযোগ, যেটা তুমি অচিনপুরে-রামকৃষ্ণালোকে পাড়ি দিলেও আজও সমানভাবে অটুট। এটাকে কি বলা যাবে? অনেক না বলা কথা যা সকলকে বলতে পারিনি কোনদিন তা আজও মনের অলিন্দের কানা গলিতে গুমরে মরে। নিজের অবচেতন মনের সঙ্গে যুদ্ধ চলতে থাকে সদা। আচ্ছা কী কারণে আমাদের বয়স বাড়ে তা কেউ কি বলতে পারবেন? যে তুমি নিজের বয়সকে কোনদিন কোনও বাঁধা বলে মনে করোনি, সকল বাঁধা অবলীলায় অতিক্রম করার এক অদম্য মানসিক দৃঢ়তা তোমাকে দিয়েছিলো অপার করুণাময় ঈশ্বর। অপরের বিপদে আগাপাস্তালা চিন্তা না করেই এগিয়ে যেতে সাহায্যের ডালি নিয়ে, সেই তোমার কেন এইরকম পরিণতি হলো! আসলে আমরা সবাই খুব স্বার্থপর, না হলে যে মানুষটি তোমার কাছ থেকে বিশেষ উপকৃত সেও কিনা তোমার শেষ যাত্রায় মুখ ফিরিয়ে রাখলো। আসলে তোমার কথাই ঠিক, প্রাণ-মন এক করে মানুষকে সরল মনে ভালোবাসে একমাত্র মাটির কাছাকাছি অবস্থান করা ওই সকল মানুষগুলি। তাইতো তোমার কলমে বারে বারেই উঠে আসত ওদের জীবনের কথা, ওদের ভালোবাসার কথা। আজ ক্ষণে ক্ষণে মনের গহন কোন থেকে উঁকি দিচ্ছে আমাদের সেই সব দিনগুলো। আচ্ছা তুমি তো এখন সব দেখতে পাচ্ছো। কি মনে হচ্ছে রতন চাচা? আজ শেষ করব তোমার কথায় কিছুটা ঠিক গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজোর মত… “ই-তূর জবর খেলা বটে।/ কালো ধোঁয়া আকাশ থেকে সরে/ রামধনু ওঠে বর্ণহীন আকাশে,/ উড়ানগাড়ি উড়ে যায় সুদূরে সীমানার বাহিরে/ মেঘ বালিকা মুচকি হেসে সরে যায়/ সরে যায় মেঘের দেশে”। (ফাইল চিত্র)