মহাত্মা গান্ধীর শহীদ দিবসে সংবাদ প্রতিখনের শ্রদ্ধাঘ্য। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ভারতের সংবাদপত্রের ইতিহাসে ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর সাংবাদিকতার নানান দিক সম্পর্কে আলোকপাত করে তাঁর মৃত্যুদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানলেন কিশলয় মুখোপাধ্যায়।
ভারতের জাতির জনক হিসাবে খ্যাত মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি সাংবাদিকতায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। গান্ধীজির সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি দক্ষিণ আফ্রিকায়। ১৯০৩-০৪ সালে তিনি যোগ দেন ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ নামক পত্রিকায়। এটি ছিল একটি ইংরাজী সাপ্তাহিক পত্রিকা। গান্ধীজি বুঝেছিলেন আন্দোলন করতে হলে সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে হবে। আর মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের সহজ মাধ্যম সংবাদপত্র। তিনি তাঁর লেখনীর মধ্যমে তাঁর চিন্তা-ভাবনা, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, জনগণের আবেগ প্রতিবাদ প্রকাশ করতেন সদা। গান্ধীজি তাঁর সত্যাগ্রহ আন্দোলন সফল করতে সক্ষম হয়েছিলেন সাংবাদিকতার জন্য একথা বলাই যায়। ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ ইংরাজী ছাড়াও তামিল, গুজরাতি ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশ হয়েছে। এই সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখায় দক্ষিণ আফ্রিকার তত্কালীন সরকারের টনক নড়ে এবং তার ফলে বেশ কিছু আইনেরও রদবদল করতে বাধ্য হয় দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার। ১৯১৪ সাল। গান্ধীজি এলেন ভারতে। যোগ দিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে, এবং স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হলেন। তিনি মনে করতেন জনগণের কাছে সঠিক খবর পৌঁছে দেওয়াই একজন দেশপ্রেমিক সাংবাদিকের কাজ। বিখ্যাত সাংবাদিক কে রামরাও গান্ধীজি সম্পর্কে বলেছেলিন, গান্ধীজি সংবাদপত্র জগতের জন্য পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করতেন। সংবাদপত্র জগতের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। তিনি তাঁর বক্তব্য, অনুপ্রেরণা ইত্যাদি জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যবহার করতেন সংবাদপত্রকে। ভারতীয় সাংবাদিকতায় তাঁর অসামান্য ভূকিকা এখান থেকেই উপলব্ধি করা যায়।
হোমরুল লীগ মুম্বাইএ প্রতিষ্ঠা করল ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকা। ১৯১৯ সাল নাগাদ গান্ধীজি এই পত্রিকার সম্পাদক হন। এই সময়ে তিনি ‘নাজীবন’ নামক একটি গুজরাতি মাসিক পত্রিকার সম্পাদকেরও দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই পত্রিকাটি ১৯৩২ সাল অবধি চলেছিল। এই পত্রিকাটি মূলতঃ গান্ধীজির ঐকান্তিক চেষ্টায় সাপ্তাহিক পত্রিকায় পরিণত হয়। তিনি তাঁর আত্মকোথায় বলেছিলেন সংবাদপত্রের উদ্দেশ্যে হলো জনগণের মনোভাব জানা এবং তা প্রকাশ করা। তিনি আরও বলেছিলেন জনগণের আবেগকে জাগ্রত করাও সংবাদপত্রের প্রধান উদ্দেশ্যে। গান্ধীজি মনে করতেন জনপ্রিয় সত্যি ঘটনাগুলিকে নির্ভীকভাবে প্রকাশ করা উচিত একটি সংবাদপত্রের। তিনি ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকা দক্ষতার সঙ্গে অনেকগুলি বছর সম্পাদনা করেছিলেন, শুধুমাত্র ইংরেজ সরকারের দৌলতে তাঁর জেলে থাকার সময়টুকু বাদ দিলে। বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাবার পর গান্ধীজি শুরু করেন ‘হরিজন’ নামক একটি ইংরাজী পত্রিকা। হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য তাঁর সংগ্রাম চিরঃস্মরণীয়। এর জন্য হরিজন পত্রিকাটি ছাড়াও গুজরাতি ভাষায় ‘হরিজন বন্ধু’ এবং হিন্দী ভাষায় ‘হরিজন সেবক’ নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি নিজে হরিজন পত্রিকার সম্পাদক না হয়েও এই পত্রিকার উন্নতির জন্য প্রভূত চেষ্টা করেছিলেন এবং পত্রিকাটিকে আন্দোলনের একটি অস্ত্রে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
গান্ধীজি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রয়োজন ও গুরুত্ব আর বিস্তারের জন্য দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য দক্ষতার সঙ্গে সংবাদপত্রকে ব্যবহার করেছিলেন। সংবাদপত্র সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব কিছু চিন্তা ভাবনা ছিলো। সম্পাদক হিসাবে তিনি অন্যরকম ভাবধারায় চলতেন। সর্বাগ্রে তিনি বিজ্ঞাপন বিরোধী ছিলেন। তাঁর পত্রিকায় কোনও বিজ্ঞাপন ছাপা হতো না। কিন্তু তিনি এটাও চাইতেন না যে পত্রিকা লোকসানে চলুক। সেইকারণে প্রচার বাড়াতে সচেষ্ট ছিলেন। সংবাদপত্র চলতে যে অর্থের প্রয়োজন তা তিনি সংগ্রহ করতেন গ্রাহকদের কাছ থেকে। পত্রিকা চালানোর পর যে অর্থ অবশিষ্ট থাকতো তা তিনি পুনরায় গ্রাহকদের ফেরত দিয়ে দিতেন নতুবা অন্য কোনও ভাল কাজে ব্যবহার করতেন। তিনি নিজে সংবাদপত্র থেকে কোনও অর্থ নিজের জন্য নিতেন না। সম্পুর্ন স্বেচ্ছাসেবক রূপে নিজের দায়িত্ব পালন করতেন। সরকার কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া কোনও নির্দেশ তা ছিলো না-পসন্দ। তিনি এটি মানতে চাইতেন না। তবে সংবাদপত্র পরিচালনার ব্যপারে সরকারের সঙ্গে সরাসরি কোনও সংঘর্ষ করেননি। এক্ষেত্রেও তিনি তাঁর নিজস্ব অহিংসনীতি মেনে চলতেন। গান্ধীজি ইংরাজী সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা মন থেকে পছন্দ করতেন না। তবুও তিনি এটা করতেন অহিন্দিভাষীদের বিশেষত দক্ষিণ ভারতীয়দের মধ্যে তাঁর মতবাদ পৌঁছে দেবার জন্য। তিনি মনে করতেন আঞ্চলিক ভাষায় সংবাদপত্র অনেক বেশি করে প্রকাশিত হওয়া উচিত। কারণ এটি অনেক বেশি সাধারণ মানুষের কাছে খবর পৌঁছে দেয়। তথ্য বলছে ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকার প্রচার সংখ্যা চিলমাত্র ১২০০, কিন্তু নবজীবন পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ছিলো ১২০০০। আর এই কারণে তিনি পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যা কমকরে ২৫০০ না হলে সেই পত্রিকার সম্পাদনা করতে চাইতেন না। পরে দেখা গেল ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে হল ৪৫০০০। গান্ধীজির সংবাদিকতার শৈলী ছিলো সোজা-সাপটা, সহজ-সরল এবং বলিষ্ঠ। তিনি বলতেন পত্রিকা একপাতার হোক, তবুও তাতে যেন সুন্দর ভাষায় লেখা থাকে। গান্ধীজি গুজরাতি ভাষার সাংবাদিকতায় এক নতুন জোয়ার নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর সময় থেকেই গুজরাতি ভাষার সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতা উন্নত হতে শুরু করে এবং অন্য আঞ্চলিক ভাষার সংবাদপত্রের সঙ্গে তাল মেলাতে শুরু করে শুধুমাত্র তাঁর লিখন শৈলীর জন্য। তাঁর চিন্তা-ভাবনা, স্বাধীনতা সংগ্রামের বক্তব্য, জনগণের মধ্যে যাঁরা দুর্বল শ্রেণী তাঁদের কথা তাঁদের অর্থনৈতিক ও সামাজিকও দূরবস্থার চিত্র প্রতিফলিত হতো তাঁর লেখায়। আর সেই লেখা সপ্তাহের শেষে পৌঁছে যেত গ্রাহকদের কাছে। তাঁর সাংবাদিকতার ভাষা অন্য সমকালীন সাংবাদিকদের প্রভাবিত করেছিলো। এখনকার সাংবাদিকদের সেই ভাষা, স্টাইল প্রেরণা যোগায়। তিনি শুধু নিজের পত্রিকাগুলো নিয়ে ভাবতেন না। তিনি সাংবাদিকতায় এতটাই সম্পৃক্ত ছিলেন, এবং সদাই তার উন্নতির কথা ভাবতেন সেটাও স্মরণযোগ্য। একবার মিঃ জায়কার গান্ধীজিকে খাদি শিল্পের উন্নতির জন্য ২৫০০ টাকা দান করেছিলেন। কিন্তু গান্ধীজি পুরো টাকাটা ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স’ পত্রিকার টিঁকে থাকার লড়াইয়ে দান করে দেন। মতিলাল নেহেরু ছিলেন সেই সময়ে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স’ পত্রিকার মালিক এবং পত্রিকাটির অবস্থা তখন একদমই ভালো ছিলো না। এই ঘটনা প্রমাণ করে ভারতীয় সংবাদপত্রের উন্নতির জন্য গান্ধীজি সদাই আন্তরিক সচেষ্ট ছিলেন। তিনি অন্য পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে মৌখিক ভাবে অথবা লেখার মাধ্যমে যোগাযোগ রেখে চলতেন।
অতএব, বলা যায় ভারতীয় সাংবাদিকতার ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধীর অবদান অনস্বীকার্য। তিনিই প্রথম আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব বুঝে তার উন্নতি কিভাবে করা যায় তা নিজে কর্মের মধ্য দিয়ে সকলকে দেখিয়ে গিয়েছিলেন।(ছবি সৌজন্যে গুগুল)