কলকাতা ছাড়িয়ে বনেদি বাড়ির পুজোর সুলুক সন্ধান

আমাদের এই বাংলার নানান প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে নানা প্রাচীন বনেদি বাড়ির ঐতিহাসিক দেবী আরাধনার ইতিহাস। আজ থেকে সংবাদ প্রতিখন আপনাদের জন্য নিয়ে আসছে সেই সকল বনেদি বাড়িগুলির দুর্গাপুজোর ইতিহাস। 

ষষ্ঠ পর্বে লিখছেন অভিজিৎ হাজরা

৪৭৯ বছরের দুর্গাবন্দনায় আজও ‘ বুহিত তোলা’ প্রথা চালু রসপুর রায় বংশের পুজোয়

সেই কামান আজ আর নেই । নেই সেই তোপের শব্দ ও। তবুও তোপের শব্দ শোনা যাবে এমন এক গভীর বিশ্বাস নিয়ে নিকটবর্তী দামোদর নদের তীরে কান পেতে থাকেন রায় পরিবারের সদস্যরা। সন্ধিপূজার সময় দামোদর নদের ঢেউ বেয়ে ভেসে আসা তোপের শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে দেবী দুর্গার হাতে বিল্বপত্র চড়ানো হয়।গ্ৰামীণ হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া উত্তর বিধান সভা কেন্দ্রে তথা আমতা থানার অন্তর্গত রসপুর গ্ৰাম।এই গ্ৰাম পূর্বতন ‘ বালিয়া পরগনার অন্তর্গত ছিল। রসপুর গ্ৰামের রায় পরিবারের এই দুর্গাপুজো ১৫৪৫ খ্রীষ্টাব্দ থেকে চলে আসছে। এবার এই পুজো ৪৭৯ বছরে পদার্পণ করল। আধুনিকতার সর্বগ্ৰাসী ব্যাপ্তির মধ্যে ও এই পুজো যে গুটিকয়েক সুপ্রাচীন প্রথা ধরে রেখেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো দামোদর নদের ঢেউয়ের শব্দে এভাবে কান পেতে থাকা।

এই পুজোর প্রবর্তক রসপুর রায় বংশের প্রতিষ্ঠাতা রায় পরিবারের কৃতি সন্তান যশচন্দ্র রায়। জানা যায়, ‘ শশাঙ্ক দেব বংশের কশ্যপ গোত্রীয় বংশে যশচন্দ্রের জম্ম।রসপুরের রায় বংশ পূর্বে নামের শেষে ‘ দেব ‘ পদবী ব্যবহার করতো।যশচন্দ্র শেরশাহের কাছ থেকেই ‘ রায় ‘ উপাধি লাভ করেন। সেই থেকেই রসপুরের ‘ দেববংশ ‘

 ‘ রায়বংশ ‘ নামে খ্যাত। বতর্মানে দেব শব্দের পরিবর্তন ঘটিয়ে কেবলমাত্র ‘ রায় ‘ পদবী ব্যবহার করে থাকে।ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি যশচন্দ্র শেরশাহের কাছ থেকে জায়গীর পেয়ে এই রসপুর গ্ৰামে এসে বসবাস শুরু করেন।গ্ৰামের সামনে দিয়েই তখন বয়ে যেত দামোদর নদ।এখন অবশ্য দামোদর নদ পূর্বতন জায়গা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। দামোদর নদের বুকে নৌকা ভাসিয়ে বাণিজ্যে যেতেন রায় বংশের সদস্যরা।ব্যবসার দৌলতে বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী যশচন্দ্র রায় ১৫৪৫ খ্রীষ্টাব্দে শুরু করেন দুর্গাপুজো। সেই পুজো আজ ও চলে আসছে অত্যন্ত নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে।রসপুর গ্ৰামের রায় বংশের পুজো বাংলার প্রাচীনতম দুর্গাপুজো গুলির অন্যতম।

রায় পরিবার শিবের উপাসক ছিল। সেই জন্য দুর্গাপুজোতে মহিষ বলি হতো। পরবর্তী সময়ে এই রায় পরিবার ২ টি মতে ভাগ হয়ে যায়। একটি অংশ বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়ে যায়।অপর অংশ শিবের অর্থাৎ শৈব শাক্ত মতেই অটল থাকে।যশচন্দ্রের নাতি রামকৃষ্ণ রায় ছিলেন রায় বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। বিখ্যাত কাব্যগ্ৰন্থ ‘ শিবায়ন ‘ – এর রচয়িতা রামকৃষ্ণ রায়।কথিত আছে, দুর্গাপূজার বলিদান মুহুর্তে এক ব্রাহ্মণ পন্ডিত রসপুর গ্ৰামের পুজো প্রাঙ্গনে উপস্থিত হন এবং রামকৃষ্ণ কবিচন্দ্রকে বৈষ্ণব শাস্ত্রমতে তর্কযুদ্ধে আহ্বান জানিয়ে আকৃষ্ট করেন। রামকৃষ্ণ রায় বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন। এরপর তিনিই পারিবারিক এই দুর্গাপূজার রীতিতে কিছু পরিবর্তন করেন।যশচন্দ্র রায় যে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেছিলেন তাতে সন্ধিপূজোর সময় মহিষ বলি দেওয়া হত। রামকৃষ্ণ রায় এই বলি রোধ করে দেবীর হাতে তুলে দেন বিল্বপত্র।এখন আর বলিদান হয় না।

যশচন্দ্র ‘ বৃহন্নন্দিকেশ্বর ‘ পুরাণ মতে দুর্গাপুজো করতেন। সাধারণ দুর্গাপুজোতে যে যে পদ্ধতিতে প্রতিমা নির্মাণ হয়, এখানে কিন্তু তার ব্যতিক্রম। এই ঐতিহ্যপূর্ণ রায় বংশের দুর্গা প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল, দেবী দুর্গার ডান পাশের উপরে থাকেন সিদ্ধিদাতা গণেশ। গণেশের পায়ের কাছে নীচে লক্ষী। দেবীর বাম পাশের উপরে থাকেন দেবসেনাপতি কার্তিক তাঁর বাহন ময়ূরের পিঠে চড়ে। কার্তিকের পায়ের নীচে সরস্বতী। একচালা ঠাকুর। গণেশের কলাবউ গণেশের পাশে।রায় বাড়ির একটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকে প্রতিমা নির্মাণের জন্য মাটি তোলা হয় জম্মাষ্টমীর দিন। মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বাঁধানো বেল গাছ তলায় ঘট স্থাপন করে শুরু হয় দেবীর বোধন। এছাড়া দুর্গা প্রতিমার পুজোতে মহাসপ্তমীর দিন তিনটি নবপত্রিকা ও ২১ টি ঘট স্থাপন করা হয় প্রতিমার চারিদিকে।চন্ডীপাঠ শুরু হয় সেদিন থেকেই।পুজো আরম্ভ হয় কৃষ্ণ নবমী তিথিতে। সেদিন থেকে শুক্লা নবমী তিথি পর্যন্ত ১৬ দিনে ১৬ টি ঘট, দেবীর ও গণেশের একটি করে ২ টি ঘট স্থাপন করা হয়। যশচন্দ্রের মৃত্যুর বহু পরে রায় বংশের বংশধরেরা সাত ঘরে বিভক্ত হয়ে গেলেও সবাই মিলে দুর্গা পূজার ব্যয়ভার বহন করতে থাকেন। এই জন্য এই পুজোকে ‘ সাত ঘরের পুজো ‘ বলা হয়ে থাকে।

পুজো উপলক্ষে যাত্রা,নাটক, হরিনাম — এই সব অনুষ্ঠান হতো। বাণিজ্য যে বংশের বিপুল ধনসম্পদের উৎস, প্রাচীনকালের নৌ নির্ভর সেই বানিজ্যের স্মৃতি ‘ বুহিত তোলা ‘ প্রথার মাধ্যমে পুজোর অনুষ্ঠানের সঙ্গে যেন সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে। নবমী পুজোর দিন বাঁশের তৈরী একটি কৃত্রিম নৌকা কুলোর উপর রেখে দেন। মধ্যরাত্রে পরিবারের একজন পুরুষ সেটি মাথায় করে বহন করেন।আর সেই পুরুষ সদস্যকে অনুসরণ করেন পরিবারের সাত বা এগারো জন সীমন্তিনী। ঢাক-ঢোল, কাঁসর-ঘন্টা ও শঙ্খ এবং উলুধ্বনির মাধ্যমে গৃহে নিয়ে যান সেই নৌকা। এই নিয়মটি ‘ বুহিত তোলা ‘ নামে খ্যাত।

এই পুজোর শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ সন্ধিপুজো। ৪৭৯ বছর আগে এই পুজোর সূচনালগ্নে তমলুকের রাজবাড়িতে ও দুর্গোৎসব হত।রাজবাড়ির কামানের ধ্বনি শুনে হাওড়ার নারিটের মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্নের বাড়ি থেকে ও দাগা হত তোপ।ন্যায়রত্ন পরিবারের তোপ – ধ্বনি শোনার জন্য খরস্রোতা দামোদর নদের তীরে উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন রসপুরের রায় পরিবারের বয়স্করা। মেঘের গর্জনের মতো গুরু গুরু শব্দ তুলে দামোদর নদের ঢেউ বেয়ে যখনই  ভেসে আসতো সেই ধ্বনি, সেই বার্তা রিলে ব্যবস্থার মাধ্যমে পৌঁছে যেত পুজোমন্ডপে।শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সন্ধিপূজোর অনুষঙ্গ হিসাবে এখানে ও কামান দাগতেন সুবল চন্দ্র রায়।

সঙ্গে সঙ্গে কোপ পড়ত মহিষের গলায়। এখন আর বলিদান না থাকলে ও সন্ধিপুজোর প্রথা বলবৎ আছে। এই সময় দেবীর হাতে তুলে দেওয়া হয় বিল্বপত্র। সন্ধিপুজো শেষ হলে কুলবধূদের নিয়ে শুরু হয় ধুনোপোড়া অনুষ্ঠান।

এই বংশের প্রবীণতম সদস্য প্রশান্ত রায়,গীতশিল্পী নিতাই রায়, বতর্মান প্রজন্মের অসীম মিত্র, পিনাকী রায়(বড়) ওরফে কৌশিক রায় বলেন,   ‘ তমলুকের রাজবাড়িতে এখন আর তোপধ্বনি হয় না। তোপধ্বনি বন্ধ হয়ে গিয়েছে নারিটের ন্যায়রত্নের বাড়িতেও। আমাদের যে কামানটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) এর পর আর সেটির খোঁজ পাওয়া যায় নি। নারিটের ন্যায়রত্নের বাড়িতে তোপ বন্ধ হয়ে গেলেও এখন ও আমরা দামোদর নদের তীরে কান পেতে থাকি। বিশ্বাসের জোরে আমরা কিন্তু তোপের শব্দ শুনতে পাই। এটা হয়তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবুও আমরা দামোদর নদের তীরে কান পেতে থাকি। বিশ্বাসের জোরে আমরা কিন্তু তোপের শব্দ শুনতে পাই ‘ । দশমীর দিন সকাল বেলায় পঞ্জিকার সময় ধরে সুতো কাটা হয়।সন্ধ্যার পর প্রতিমা নিরঞ্জন হয় দামোদর নদে।

 

%d bloggers like this: