গমের আটা বা ময়দা আমরা সকলেই জানি। গম ছাড়াও বজ্র, ভুট্টা ইত্যাদির আটা বা ময়দাও আমাদের অজানা নয়।কিন্তু আমরা কতজন খবর রাখি নারকোলের আটা বা ময়দা প্রসঙ্গে। সেই বিষয় নিয়ে লিখলেন আত্রেয়ী দো
আচ্ছা, নারকেল শব্দটা শুনলেই প্রথমে কোন খাবারের কথা মাথায় আসে বলুন তো? ঠিকই বলেছেন নাড়ু। আমি নিজে নারকেলের নাড়ু ভীষণ রকম পছন্দ করি। সামনেই আসছে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব, দুর্গোৎসব। শৈশবের নানান স্মৃতি আজও আমার স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। প্রতিবছর দুর্গাপূজোর সময় দেখতাম ঠাম্মা আমাদের জন্য নারকেলের নাড়ু, গজা, নিমকি নিজের হাতে যত্ন করে বানিয়ে রাখতেন। কিছুদিন আগেই মায়ের সাথে এই নিয়ে গল্প করছিলাম। জন্মাষ্টমীর দিন দেখি মা নারকেলের নাড়ু বানাচ্ছে। মায়ের পাশে বসলাম হাতে হাতে সাহায্য করে দেবো বলে। একটা নারকেলের মালা নিয়ে তার শাঁস কুড়াতে কুড়াতে হঠাৎ মাথায় এলো নারকেলের তো অনেক পুষ্টিগুণ, কিন্তু সবতো জানিনা। নাড়ু বানিয়ে এসে বসলাম নারকেল নিয়ে থুড়ি নারকেলের গুণাগুণ নিয়ে। খুঁজে পেলাম কিছু নতুন তথ্য যা আমার, হয়তো বা অনেকেরই অজানা।
আচ্ছা নারকেলের জল, নারকেল ভাজা, নারকেল কুড়িয়ে নাড়ু, পিঠে কিংবা ভাপা ইত্যাদি সবকিছুই কম বেশি আমরা সবাই খেয়ে থাকি। কিন্তু নারকেলের আটা কিংবা ময়দা? অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই। গমের পাশাপাশি ভুট্টা, জোয়ার, বাজরা অথবা নানান শস্যের একত্রে অর্থাৎ মাল্টিগ্রেনসের আটা বা ময়দা আমরা অনেকেই খেয়ে থাকি। কিন্তু নারকেলের আটা বা ময়দার সাথে হয়তো বা আমরা অনেকেই পরিচিত নই। চলুন তাহলে এর সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
প্রথমে বলি ,নারকেলের আটা বা ময়দা জিনিসটা কি?
নারকেলের শাঁস শুকনো হয়ে যে নরম মাংসল ময়দার মত জিনিস তৈরি হয়, তাকে নারকেলের আটা, ময়দা বলে। নারকেলের শাঁস থেকে দুধ নিঃসরণ করার পর যে মাংসল অংশ পড়ে থাকে, তা কম তাপমাত্রায় শুকনো করে এই আটা ও ময়দা তৈরি করা হয়। এটি দেখতে সাদা বা ঘিয়ে রঙের হয়ে থাকে।
পুষ্টিগুণ:
১/৪ কাপ বা ৩০ গ্রাম নারকেলের আটা বা ময়দায় রয়েছে –
১. ক্যালোরি – ১২০
২. কার্বোহাইড্রেট – ১৮ গ্রাম
৩. প্রোটিন – ৬ গ্রাম
৪. ফ্যাট – ৪ গ্রাম
৫.ফাইবার – ১০গ্রাম
৬. চিনি – ৬ গ্রাম
৭. আয়রন – ২০%
উপকারিতা:
১. গমের আটা বা ময়দার মতোই নারকেলের আটা বা ময়দা বেকিংয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়। তবে নারকেলের আটা ময়দায় গ্লুটেন থাকে না। তাই যে সমস্ত ব্যক্তির গ্লুটেনে অ্যালার্জি রয়েছে তারা নিরাপদে একটি ব্যবহার করতে পারেন। শুধু এটাই নয়, গ্লুটেন থেকে সৃষ্ট বিভিন্ন অটোইমিউন ডিসঅর্ডার যেমন সিলিয়াক ডিসিস, ক্রোনস ডিসিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি অসুখে আক্রান্ত ব্যক্তিরাও এটি বেছে নিতে পারেন।
২. গমের আটার তুলনায় নারকেলের আটা বা ময়দায় অনেক বেশি ফ্যাট,প্রোটিন ও ফাইবার রয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক খনিজ হিসেবে এতে রয়েছে উচ্চমাত্রায় আয়রন। নিরামিষাশীদের কাছে এটি আয়রনের খুব ভালো একটি উৎস।
৩. গমের আটা বা ময়দার তুলনায় নারকেলের আটা বা ময়দার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম থাকে। ফলে শর্করা হজম এবং শোষণ করতে বেশি সময় লাগে। তাই রক্তে শর্করার মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি উপকারী।
৪. ইনোভেটিভ ফুড সায়েন্স এন্ড ইমার্জিং টেকনোলজিস দ্বারা প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা গেছে, নারকেলের আটা এবং ময়দায় উপস্থিত ফাইবার জাতীয় উপাদান রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়, রক্ত শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং কার্ডিওভাসকুলার বা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতিদিন ১৫-২৫ গ্রাম নারকেলের ফাইবার সেবনে রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা ১১%, এল.ডি.এল অর্থাৎ যাকে আমরা খারাপ কোলেস্টেরল বলি তার মাত্রা ৯% এবং ট্রাইগ্লিসারাইড ২২% পর্যন্ত কমে।
৫. ওজন কমাতেও নারকেলের আটা বা ময়দার জুড়ি মেলা ভার। এতে উপস্থিত উচ্চমাত্রার ফাইবার দীর্ঘক্ষণ পেট ভর্তি থাকার অনুভূতি দেয় এবং সেই সাথে এনার্জি লেভেল অর্থাৎ শক্তির মাত্রা বাড়িয়ে খিদে কমাতেও সাহায্য করে। তাই,যারা ওজন কমাতে চাইছেন তারাও খাদ্য তালিকায় গমের আটা বা ময়দার পরিবর্তে বেছে নিতে পারেন নারকেলের আটা বা ময়দা।
৬. এতে রয়েছে মিডিয়াম চেইন ট্রাইগ্লিসারাইড (এমসিটি)। এই জাতীয় ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি চর্বি হিসেবে শরীরের সঞ্চিত না হয়ে সরাসরি লিভারে পৌঁছে শক্তি উৎপাদন করে ফলে দেহে অতিরিক্ত চর্বি জমার সম্ভাবনা থাকে না।
৭. নারকেলের আটা বা ময়দায় দ্রবণীয় এবং অদ্রবনীয় দুই ধরনেরই ফাইবার থাকার দরুন এটি হজমের সমস্যা মেটাতে সাহায্য করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। শুধু তাই নয় এটি অন্ত্রের স্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে।
৮. এতে তুলনামূলকভাবে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া খুবই নগণ্য। তবে উচ্চমাত্রায় ফাইবার থাকার দরুণ কিছু ব্যক্তির এটি সেবনে ফোলা ভাব অনুভব হতে পারে।
ব্যবহার:
রুটি, বিস্কুট, প্যানকেক, মাফিন অর্থাৎ যে কোনো বেকড আইটেম প্রস্তুতিতেই নারকেলের আটা, ময়দার ব্যবহার করা যেতে পারে। বলা যেতে পারে এটি গমের আটা বা ময়দার একটি খুবই স্বাস্থ্যকর বিকল্প।
তবে গমের আটা বা ময়দার তুলনায় এটি বেশি ঘন এবং এর তরল শোষণ করার ক্ষমতাও অনেক বেশি। যেহেতু এতে গ্লুটেন থাকেনা তাই গমের আটা বা ময়দার থেকে অনেক বেশি সময় ধরে এটি মাখতে হয়।
তাহলে কী ভাবছেন এরপর থেকে কোনটা ব্যবহার করবেন? গমের না নারকোলের আটা।