এই পল্লীর মাটি ছাড়া মা দুর্গার মূর্তি নির্মাণ অসম্পূর্ণই থেকে যায়

পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উত্‍সব দুর্গোত্‍সব আসন্ন, যদিও এই মূহুর্তে প্রকৃতি চোখ রাঙাচ্ছে আমাদের। দুর্গাপুজোয় বিশেষ করে যে জিনিসটি ছাড়া দুর্গা প্রতিমার মূর্তি বানানো অসম্পূর্ণ সেই বিষয় নিয়ে লিখলেন আত্রেয়ী দো

সমাজের কাছে নিষিদ্ধ হলেও এই পল্লীর মাটি ছাড়া মা দুর্গার মূর্তি নির্মাণ অসম্পূর্ণ। এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে নানান কারণ। জানেন কি?

হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী অকালবোধনের সময় সমগ্রিক বা আংশিকভাবে মা দুর্গার মূর্তি তৈরি করতে হয় নিষিদ্ধপল্লীর মাটি দিয়েই। দুর্গাপ্রতিমা মাটির পরিবর্তে ধাতু বা অন্যকিছু দিয়ে নির্মাণ করা হলে, মঙ্গলঘটে দিতে হয় নিষিদ্ধপল্লীর মাটি, নতুবা পুজো অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

‘নিষিদ্ধপল্লী’ নামটাই বুঝিয়ে দেয় সমাজের কাছে এই পেশার নারীরা নিষিদ্ধ। অথচ এই জায়গার মাটি ছাড়া বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজোই অসম্পূর্ণ। পতিতাদের সমাজ নিষিদ্ধ করলেও যুগ যুগ ধরে এরাই কিন্তু সমাজের সমস্ত কলুষ নিজেদের শরীরে ধারণ করে সমাজকে শুদ্ধ করে চলেছে। দেবতা, রাজ-বাদশাই হোক বা সম্ভ্রান্ত পরিবারের পুরুষ কিংবা হোক কোনো মুনি-ঋষি-পূজারী ,কারোরই কামের রোষ থেকে বাদ যাইনি পতিতারা। স্থানভেদে বদলেছে শুধু নাম, কোথাও হয়েছে রক্ষিতা কোথাও বা সেবাদাসী। কিন্তু প্রত্যেক পুরুষই সম্ভ্রমের সাথে প্রবেশ করতেন পতিতাদের কক্ষে। কারণ,মনে করা হয় চৌষট্টি কলায় পারদর্শী এই পতিতারা দেবতাদের থেকেও শক্তিশালী। এই বিশ্বাসের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে এক পৌরাণিক কাহিনী। জানা যায় একবার ঋষি বিশ্বামিত্র ইন্দ্রত্ব লাভের জন্য কঠোর তপস্যায় বসেন। তার ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন দেবরাজ ইন্দ্র। কিন্তু সকল প্রচেষ্টার পরেও তিনি ব্যর্থ হন। তখন ইন্দ্রদেবের নির্দেশে স্বর্গের এক অপ্সরা নর্তকি মেনকা যান ঋষি বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভঙ্গ করতে। যা স্বয়ং ইন্দ্রদেব পারলেন না তা অনায়াসে নৃত্যের মাধ্যমে করে ফেললেন এক নারী। স্বর্গের অপ্সরী হলেও তিনি তথাকথিত ‘সতী’ নন। তাই তাঁরা দেবতাদের থেকেও ক্ষমতাশালী বলে মনে করা হয়।

শারদীয়া দুর্গাপূজায় অর্থাৎ অকালবোধনে দেবী দুর্গা মোট নয়টি রূপে পূজিত হন। এই নয়জন কন্যা হলেন যথাক্রমে নর্তকী,কাপালিনি, ধোপানি, নাপিতানি, ব্রাহ্মানী, শুদ্রানি, গোয়ালিনী,মালিনী ও পতিতা। তাই দুর্গাপূজায় নবমকন্যার অর্থাৎ পতিতালয়ের মাটি প্রয়োজন হয়।

তবে, মতান্তরে আরও একটি বিশ্বাস প্রচলিত আছে। পুরুষেরা কামনা,বাসনা,লালসা চরিতার্থ করার জন্য পতিতালয়ে প্রবেশ করে। মনে করা হয়, পুরুষেরা কামনা-বাসনার সাথে সাথে নিজেদের সঞ্চিত সমস্ত পুণ্য সেখানে ফেলে আসে,আর ফেরার সময় সাথে নিয়ে আসে পাপের ঘরা। হাজারো পুরুষের পুণ্যে পতিতালয়ের মাটি হয়ে ওঠে পবিত্র,আর এই কারনেই মায়ের মূর্তি তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এই মাটি। এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে পুরুষদের সমস্ত পাপ, অশুদ্ধতা পতিতারা নিজেদের দেহে ধারণ করে নিজেরা ‘অশুদ্ধ’ হয়ে সমাজকে পরিশুদ্ধ করে চলেছে।

কি অদ্ভুত আমাদের সমাজ। পুরুষরাই নারীকে পতিতা বানায় অথচ, ‘অপবিত্র’, ‘নিষিদ্ধ’ এই বিশেষণগুলো ব্যবহৃত হয় নারীদের জন্যে। আসলে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষদের হয়তো সবকিছুর ওপরেই তথাকথিত ‘অধিকার’ রয়েছে। কিন্তু আসলেই কি পতিতারা অশুদ্ধ?অশুচি? মোটেও না। যে নারীর গর্ভে পুরুষ জন্মায়, পুরুষের সাধ্য নেই সেই নারীকে অশুদ্ধ করার। পতিতাপল্লীর অন্দরে কান পাতলে শোনা যাবে, অনেকেই হয়তো স্ব-ইচ্ছেয় এই পেশায় আসেনি, এসেছে পরিস্থিতির শিকার হয়ে। এখানে এসে কিছু নারীলোলুপ পুরুষের ক্ষুধা নিবারণ করে আজ সমাজের চোখে হয়ে উঠেছে ‘ঘৃণ্য’,’নিষিদ্ধ’। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও হয়তোবা এই রীতির প্রচলন হয়েছে।

কারণ যাই হোক প্রাপ্তির বিষয় একটাই, সমাজের চোখে ঘৃণ্য,নিষিদ্ধ নারীদের বাসস্থানের মাটি দিয়েই গড়া দেবী মায়ের সামনে নতজানু হয়ে প্রণাম করে সমাজের তথাকথিত ‘শুদ্ধ’ পুরুষ সহ সকলেই ।সবশেষে এটুকুই বলবো, শুধু জাতি-ধর্ম-বর্ণই নয়, সমস্ত পেশার মানুষ এক হয়ে মেতে উঠুন উৎসবে। দুর্গাপূজা শুধু পুজোই নয়, এ হল সর্বজনীন মিলনৎসব। ঘৃন্য ,নিষিদ্ধ বলে দূরে ঠেলে নয় ,সবাই মিলেমিশে চলুন উপভোগ করি এই উৎসব।

%d bloggers like this: