অনর্থক চিবোনোর এক রসালো গল্প

আত্রেয়ী দো: বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার মাঝেই চুইংগাম বেশ জনপ্রিয়। বর্তমানে বাজারে নানান ধরনের নানান স্বাদের চুইংগাম পাওয়া যায়। কিন্তু পূর্বে তা ছিল না। রসালো স্বাদের এই জিনিসটি চিবোতে চিবোতে একসময় স্বাদ চলে যায়,তবু চিবোনো যেন থামতে চায়না। এই চুইংগাম আবিষ্কারের কাহিনীটি আমাদের অনেকেরই হয়তো অজানা। তাহলে আর কি,মুখে একটা চুইংগাম ভরে চিবোতে চিবোতে চলুন জেনে নিই এই রসালো জিনিসটি আবিষ্কারের নেপথ্য কাহিনী।

চুইংগাম বা চিউয়িংগাম যার অর্থ হল চিবোনো যায় এরকম এক ধরনের  আঠালো পদার্থ। সালটা ১৮৬০। মেক্সিকোর সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আন্তনিও লোপেজ শিকল(chicle) নামক দক্ষিণ আমেরিকার একটি গাছের রস নিয়ে আসেন টমাস অ্যাডামসের জন্য। তার উদ্দেশ্য ছিল এই শিকল থেকে রাবার তৈরি করা। টমাস অ্যাডামস এই শিকল নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রাবার প্রস্তুত করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু বারংবার ব্যর্থ হওয়ায় বিরক্তিতে তিনি জিনিসটি মুখে পুরে নেন। স্বাদগ্রাহী হওয়ার দরুন জিনিসটি মুখের মধ্যে ভরে, চিবিয়ে বাবল তৈরি করেন। এই অবকাশেই তাঁর মাথায় জ্বলে ওঠে ‘বুদ্ধির বাতি’। ১৮৭০ সালে তাঁর হাত ধরেই আধুনিক চুইংগাম বাণিজ্যিক রূপ পায়। তাঁর চুইংগাম কোম্পানি ‘অ্যাডামস নিউইয়র্ক চুইংগাম’ হয়ে ওঠে নিউইয়র্কের এক নম্বর চুইংগাম কোম্পানি। চুইংগাম উৎপাদনের জন্য প্রথম ভেন্ডিং মেশিন তৈরি হয় নিউইয়র্কেই। তাঁর তৈরি চুইংগামের নাম ছিল ‘Tutti-Frutti’। প্রথম ভেন্ডিং মেশিনের সাহায্যেই তৈরি করা হয় এই চুইংগাম। ধীরে ধীরে চুইংগামের জনপ্রিয়তা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

তবে চুইংগাম আবির্ভাবের কাহিনীটি আরো প্রাচীন। ২০১৯ সালের ১৭ ই ডিসেম্বর ‘নেচার কমিউনিকেশনস’ নামক একটি বৈজ্ঞানিক সাময়িকির অন্তর্ভুক্ত একটি গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ৫৭০০ হাজার বছর আগেও চুইংগামের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। একদল প্রত্নতাত্ত্বিক ডেনমার্কে খননকার্য চালিয়ে আবিষ্কার করেছেন সেই প্রমাণ। সেই খনন কার্যেই চুইংগামের ওপর এক তরুণীর দাঁতের ছাপ পাওয়া গেছে। তবে ওই চুইংগামটি ছিল মূলত বার্চ গাছ নিঃসৃত জমাট বাধা রস।

তবে বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায় প্রাকৃতিক চুইংগামের কাহিনীটি অনেক হাজার বছর আগেকার। প্রাচীন গ্রিক অধিবাসীরা ম্যাসটিক নামক একটি গাছের আঠালো রস ম্যাসটিচ জমাট বেঁধে যাওয়ার পর চুইংগাম হিসেবে চিবোতো। গ্রিক শব্দ ‘ম্যাসটিচ’এর অর্থ হল চিবোনো। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, মানব সভ্যতার ইতিহাসে এটিই প্রথম চুইংগাম। গ্রিকরা মনে করতেন এই ম্যাসটিচ দাঁতের ক্ষয় এবং মুখের ময়লা পরিষ্কার করতে সহায়ক। এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির মানুষেরা নানান গাছের রসকে চুইংগাম হিসেবে ব্যবহার করতো।প্রাচীন মায়ান জাতিরা স্যাপোডিলা নামক গাছের রস জমাট বাঁধার পর চিবোতো। প্রাচীন ভারতীয়রা স্প্রুস গাছের রসকে জমাট বাঁধার পর চুইংগাম হিসেবে চিবোতো। আবার যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীরা গাছের বাকলের সঙ্গে মৌচাকের মোম মিশিয়ে তৈরি করতো চুইংগাম। প্রাচীন চৈনিক, এস্কিমো জাতির মধ্যেও ছিল চুইংগামের চল।

বাণিজ্যিক ভাবে প্রথম চুইংগামের উদ্ভাবক হলেন বেকন কার্টিস। ১৮৪৮ সালে  বেকন কার্টিস স্প্রুস গাছের রসের সঙ্গে ফ্লেভার মিশিয়ে তৈরি করেন চুইংগাম,যার নাম ছিল ‘দ্য স্টেট অফ মেইন পিওর স্প্রুস গাম’। প্রথম চুইংগামের ফ্যাক্টরির নাম ছিল ‘Curtis Chewing Gum Factory’। ১৮৫০ সাল নাগাদ বাজারে আসে প্যারাফিন থেকে তৈরি হওয়া নতুন এক ধরনের চুইংগাম।

প্রথমদিকে চুইংগামগুলিতে খুব বেশি ফ্লেভার ছিল না। প্রথম ফ্লেভার দেওয়া চুইংগাম আবিষ্কার করেন কেন্টাকির লুইসভিলের বাসিন্দা ক্লোগান নামের একজন ফার্মাসিস্ট। চিনিগুঁড়োর সাথে টোলু নামক সুগন্ধি রজন মিশিয়ে চুইংগাম স্টিক প্রস্তুত করেন তিনি। এর নাম দিয়েছিলেন ‘ট্যাফি টোল’। ফ্লেভার জনিত সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন আরও একজন,নাম উইলিয়াম হোয়াইট। তিনি চুইংগামে বিভিন্ন ফ্লেভার যোগ করেন। তিনি চুইংগামের সঙ্গে চিনি, কর্নসিরাপ ও পিপারমেন্ট যোগ করে চুইংগামের ফ্লেভারকে অন্য মাত্রা দেন। ড. এডওয়ার্ড বিমান চুইংগামে পেপসিন পাউডার যোগ করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল চুইংগামকে হজমের সহায়ক বানানো।

এরপরেও চুইংগামের স্বাদ নিয়ে নিত্যনতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে। পরবর্তীকালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চুইংগামের স্বাদ ও উৎপাদন পদ্ধতিতে এসেছে পরিবর্তন। চুইংগাম প্রস্তুতিতে প্রাকৃতিক উপাদানের পরিবর্তে বুটান্ডিয়েন গোত্রীয় কৃত্রিম রাবার জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। চুইংগাম প্রস্তুতির মূল উপাদান হলো তিনটি – ১. রজন, ২. মোম এবং ৩. ইলাস্টেন নামক জৈব যৌগ।

এতো গেল আবিষ্কারের কাহিনী। আচ্ছা, চুইংগাম এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল কিভাবে? সেই কাহিনীও জেনে নেওয়া যাক। জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সেনাদের রেশন হিসেবে চুইংগাম দেওয়া হত। সেই সময় ছিল বিনিময় প্রথার চল। সৈনিকরা সেই চুইংগাম স্থানীয় অধিবাসীদের দিয়ে তার বিনিময়ে তাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করত। এভাবেই বিস্তৃতি লাভ করে চুইংগাম।

বর্তমানে জনপ্রিয়তার নিরিখে চুইংগাম অনেকখানি পিছিয়ে রয়েছে তা বলাই যায়। তবে দোকানে রকমারি চকলেট, বিস্কুটের ভিড় ঠেলে চুইংগাম আজও প্রথম সারির কাঁচের বয়ামে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু বিক্রি অনেকাংশে কমে গেছে। ওই কিছু ক্রেতা অন্যান্য জিনিসের সাথে ক্ষণিকের আবেগে ভেসে আজও কিছু চুইংগাম বাজারের থলিতে ভরেন, ইংরেজিতে যাকে ‘ইম্পালস বাই’ বলা হয়ে থাকে। তবে সদর্থক জিনিসের মাঝে অনর্থক চিবোনোর জিনিস এই চুইংগাম নিজের জায়গা করে ছিল, আছে এবং থাকবেও।

%d bloggers like this: