শুধু চুক্তি নয়, গৃহীত হোক কার্যকরী প্রদক্ষেপ – পুনর্গঠিত হোক জীববৈচিত্র্য

আত্রেয়ী দো: পৃথিবীতে কবে কোথায় প্রথম প্রাণের সঞ্চার হল, কিভাবে প্রথম কোষ সৃষ্টি হল, কিভাবেই বা হল উদ্ভিদ ও প্রাণীর সৃষ্টি- ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনাকে সরিয়ে রেখে আমরা প্রাণ ভরে উপভোগ করছি প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা উদ্ভিদ,প্রাণী,ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস,ছত্রাক প্রভৃতির ভারসাম্য যুক্ত আবাসস্থল এই পৃথিবীকে। প্রথম প্রাণের সঞ্চার থেকে শুরু করে নানান উত্থান-পতন, আবির্ভাব-অবলুপ্তি এবং নানান প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য  ইত্যাদি বহু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে জীব বৈচিত্র্যের বর্তমান অবস্থার প্রকাশ ঘটেছে। প্রকৃতির এই বৈচিত্র্যময় জীব বৈচিত্রের বর্তমান অবস্থায় পৌঁছাতে সময় লেগেছে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বছর।

বিজ্ঞানী উইলসন এর একটি গবেষণা থেকে জানা যায় বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৯০ মিলিয়ন প্রজাতির জীব বসবাস করে। ভারতীয় উপমহাদেশের বাসস্থান এবং জলবায়ুর বিভিন্নতা,ভৌগোলিক অবস্থান, বিভিন্ন প্রকার বাস্তুতন্ত্রের উপস্থিতির জন্য আমাদের দেশ ভারতবর্ষকে বলা হয় “মেগা বায়োডাইভারসিটি দেশ”। পৃথিবীর সমগ্র ভূখণ্ডের প্রায় ২% এবং পৃথিবীর সমগ্র জৈব প্রজাতির ৬% ভারতবর্ষে অবস্থিত। ভারতবর্ষে প্রায় ৫০০০০ উদ্ভিদ প্রজাতি এবং ৯০০০০ প্রাণী প্রজাতির বসবাস। এছাড়াও ভারতে সপুষ্পক উদ্ভিদের প্রজাতি সংখ্যা প্রায় ২০০০০, পতঙ্গ প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৫৮০০০, মোলাস্কা প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৫০০০ ও অমেরুদন্ডী প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা ৭০০০। মেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে মাছের প্রজাতি প্রায় ২৫০০, এম্ফিবিয়া প্রজাতি প্রায় ২০০, সরীসৃপ প্রজাতি প্রায় ৪৫০, পাখি প্রজাতি প্রায় ১২০০ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রজাতি প্রায় ৩৯০। এছাড়াও রয়েছে বহু ধরনের কৃষিজ উদ্ভিদ।

এই জীববৈচিত্র্যগুলি প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে এক একটি বাস্তুতন্ত্রে সাম্যবস্থা বজায় রেখে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। শুধু জীব সম্প্রদায়ের মধ্যেই নয়, জড় পদার্থের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমেও একাধিক বাস্তুতান্ত্রিক সাম্যবস্থা বজায় রয়েছে। মানুষের সংযোজন জীব বৈচিত্র্যের সামান্য একটি অংশ মাত্র। সভ্যতার বিকাশ হচ্ছে, সেই সাথে সাথে মানুষ নিজের প্রয়োজনের তাগিদে অজ্ঞানে এবং সজ্ঞানে এই প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার করে চলেছে। ফলে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হতে চলেছে যেখানে ভবিষ্যতে মানুষের নিজেদের অস্তিত্বই সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। মানুষ এই জীব বৈচিত্রের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। অথচ মানুষেরই কার্যকারিতার ফলে এই জীব বৈচিত্র্য সংকটপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সেই কারণেই বিশ্বব্যাপী সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২২শে মে বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে, ‘আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস’।

প্রথমে, ১৯৯২ সালের ২২ শে মে, কেনিয়ার নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত জীববৈচিত্র্য বিষয়ক কনভেনশনের দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পরে, ১৯৯৩ সালের শেষ দিকে, দিবসটি পালনের জন্য ২৯ ডিসেম্বর দিনটি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশই এই দিবস উদযাপন করা বন্ধ করে দিলে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০০২ সালের ২২ শে মে দিনটি জীববৈচিত্র্য দিবস উদযাপনের দিন হিসেবে পুনঃনির্ধারণ করেন।

১৯৯২ সালের ৫ই জুন, ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে, জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচীর ‘ধরিত্রী সম্মেলনে’ বায়োডাইভারসিটি চুক্তির (সিবিডি) প্রস্তাব গৃহীত হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ১৬৮টি দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ওই বছরের ২৯ ডিসেম্বর থেকে চুক্তিটি কার্যকর করা হয়। বর্তমানে এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা প্রায় ১৯৫ টি।

প্রতিবছরই ভিন্ন ভিন্ন থিম মনোনয়ন করে সেই আঙ্গিকে দিবসটি উদযাপন করা হয়। এই বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। এই বছরের থিম হল -” চুক্তি থেকে পদক্ষেপ : জীব বৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনুন।”

সবশেষে একটাই কথা বলার, আমাদের অসচেতনতার কারণে পরিবেশের যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়ে চলেছে তার খেসারত আমাদের এবং আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মেকেই দিতে হবে। কাজেই শুধুমাত্র চুক্তিতে আবদ্ধ না থেকে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের দায়িত্বে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। আর নিজেদের সচেতন হতে হবে যাতে আমাদের কোন কাজের মাশুল পরিবেশের অন্য কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদকে দিতে না হয় নতুবা একদিন সমগ্র পৃথিবীর অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।

%d bloggers like this: