সরস্বতী পুজো উপলক্ষে বলরামের মেলা বোড়বলরাম গ্রামে

কিশলয় মুখোপাধ্যায়: পূর্ব বর্ধমান জেলার রায়না ১ নম্বর ব্লকের অন্তর্গত বোড়বলরাম গ্রাম। প্রাচীন ও বর্ধিষ্ণু এই গ্রামের অতীতে নাম ছিল বোড়। এখানে রয়েছে প্রাচীন বলরাম বা বলভদ্র দেবের মন্দির। তাই এখন গ্রামের নাম বোড়বলরাম। সরস্বতী পুজোর দিন থেকে এগারো দিন অর্থাৎ পূর্ণিমা পর্যন্ত এই মন্দির চত্ত্বরে বিরাট মেলা বসে। এ বছর ২৬ জানুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলেছে এই মেলা।  নিম কাঠের তৈরি অপূর্ব সুন্দর দেখতে বিগ্রহটির রয়েছে চোদ্দ টি হাত। হাতে রয়েছে মুষল, গদা, চক্র ও শঙ্খ। একটি হাত অর্ধ উন্মুক্ত। বাকি ন টি হাতে অস্ত্র আর সস্ত্র নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে ছুঁড়ে আঘাত করা হয় তাকে বলে অস্ত্র। যেমন চক্র, আধুনিক কালে বুমেরাং। আর যা হাতে ধরে রেখে আঘাত করা হয় তাকে বলে শস্ত্র। যেমন গদা অথবা মার্শাল আর্টের নানচাকু। প্রায় বারো ফুট উচ্চতার বলভদ্র দেবের এই চতুর্দশভূজ মুর্তিটি ত্রিনয়ন। চোখ গুলি গোলাকার এবং পুরীর বিগ্রহের চোখের সঙ্গে মিল রয়েছে। মাথায় রয়েছে তেরো টি নাগছত্র বা মুকুট। এই তেরো টির মধ্যে সাত টি বিষ্ণুর ও ছ টি বলভদ্রের। লাঙলবাহী সংকর্ষণ হলেন কৃষির দেবতা এবং নাগ হল উর্বতার প্রতিক। বিষ্ণুপুরাণে দেখা যাচ্ছে বলরামের সঙ্গে নাগ বা সর্পকুলের সুসম্পর্ক রয়েছে। বলরামের দুটি কর্ণকুন্ডলের একটি নাগরাজ অনন্তের কর্ণে শোভিত। শুভ্র বর্ণের মুর্তিটির মধ্যে বিষ্ণু ও বলরামের মিলিত রূপটি প্রকাশ পেয়েছে। এখানে সম্ভবত চোদ্দ টি হাতের মধ্যে বিষ্ণুর দশদিক বা দশাবতার এবং চার টি বলরামের, এই ভাবে কল্পনা করা হয়েছে। আসলে এই মন্দির ও মুর্তিটির ইতিহাস, পুজোর আচার, সারা বছর বিভিন্ন যে মেলা বসে তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শৈব ধারা, বৈষ্ণব ধারা, জৈন সংস্কৃতি, বৌদ্ধ সংস্কৃতি, লৌকিক তথা স্থানীয় সংস্কৃতি সব এক হয়ে মিশেছে এই মন্দির চত্বরে, বলরাম দেবের কাছে । যেমন পুজো পদ্ধতির বিভিন্ন আচারে অনুষ্ঠানে দেখা যায় বৌদ্ধ  সংস্কৃতির প্রভাব এবং বৌদ্ধ পূর্ণিমার দিনএই মন্দিরের বার্ষিক পুজো হয়। এছাড়া নাগছত্র মুকুটটির মধ্যে জৈন পুরাকীর্তির ছাপ রয়েছে। এছাড়া জৈন ধর্মে বিষ্ণুর  অষ্টম অবতার হলেন বলদেব। বলরাম তাল বৃক্ষের আঘাতে ধেনুকাসুর বধ করেছিলেন। ধেনুকাসুর ও তার বন্য গর্দভকুল যমুনা নদীর তীরে তাল গাছের জঙ্গলে রাজত্ব করতেন। পৌরানিক কাহিনীতে দেখা যায় বলরাম একদিকে মুষল হাতে ধেনুকাদি বন্য ওই গাধার পালকে বধ করে শস্যক্ষেত্র রক্ষা করছেন অন্যদিকে তিনি কৃষি দেবতা রূপে পূজিত হচ্ছেন।

পূর্ব বর্ধমান জেলাকে বলা হয় পশ্চিমবঙ্গের শস্যভান্ডার। এখনতো ধানের গোলা দেখা গেলেও ‘ধানের মরাই’ লুপ্তপ্রায়। পাশের গ্রাম তেয়ান্ডুলে বেশ কয়েকটি ধানের মরাই দেখা গেল। একটি বাড়ির সামনে চারটি ধানের মরাই পর পর দাঁড়িয়ে আছে। এখানে পৌষ আনি উৎসবের ব্যাপক চল রয়েছে। বোড়বলরাম গ্রামের ইতিহাস, বলরামের মন্দির, দেবমুর্তি, কৃষিকাজ, পৌষআনি উৎসব, নবান্ন এসব নানা বিষয় আড্ডার মেজাজে গল্প হচ্ছিল এই তেয়ান্ডুল গ্রামের বাসিন্দা প্রদীপ ভট্টাচার্য এবং তাঁর বাবা বর্ষিয়ান সদানন্দ ভট্টাচার্যের সঙ্গে।

বোড়বলরাম অঞ্চলের বলরাম দেব কৃষি দেবতার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিরও দেবতা। গ্রামের মানুষ বলরামের উদ্দেশ্যে জলভোগ ও ক্ষীরভোগ নিবেদন করে। দুধকে ঘন করে এই ক্ষীর তৈরি করা হয়। এখানকার বাসিন্দারা বিশ্বাস করেন এই ক্ষীর নিবেদন করলে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হবে। এই দিন বলরাম দেবের ‘হল’ নাড়িয়ে দেওয়া হয় আর এই দিন হলকর্ষণ বন্ধ থাকে। মন্দিরটি মূূল রাস্তা থেকে প্রায় ১৪ ফুট ওপরে  ৮০x৬৫ ফুট জায়গায় অবস্থিত। মন্দিরের প্রবেশ পথটি বাংলা দোচালা আকৃতি। বিগ্রহের পেছনে চালচিত্রে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার চিত্র সহযোগে অন্যান্য চিত্র আঁকা হয়েছে যা দেখতে সুন্দর লাগে।

বৈশাখ মাসের অক্ষয় তৃতীয়ার দিন বলরাম দেবের স্নানযাত্রা হয় তারপর হয় অঙ্গরাগ। এই মাসের চতুর্দশীর দিন দেবমুর্তির চক্ষুদান উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আর এই সময় হয় বিরাট গাজন মেলা। এই মন্দিরের এই মেলাটিই সবচেয়ে বড় মেলা। বৈশাখ মাসে এরকম বলরামের গাজন উৎসব অন্যকোথাও হয় বলে মনে হয়না। আর এই সম্পর্কে কোন পৌরানিক ব্যাখ্যা নেই। ধর্মরাজ ও শিবের গাজনের মতো এখানেও অনেকে বলরামের সন্ন্যাসী হন। পূর্ণিমার দিন মন্দিররের বাইরে একতলার সমান উঁচু ছাদ থেকে সন্নাসীরা নিচে খড়ের গাদায় ঝাঁপ দেন। এই প্রথাটির নাম হল ‘পাটভাঙা’। এই প্রথা দেখতে প্রচুর জন সমাগম হয়। এর আগে একাদশ তিথিতে নিজের গোত্র ত্যাগ করে বলরামের গোত্র গ্রহণ করেন। চতুর্দশীর দিন সন্ন্যাসীরা সম্পূর্ণ উপবাসে থাকেন। বৈশাখ মাসে চক্ষুদান ও গাজন উৎসবের পর জন্মাষ্টমী পালন করা হয়। ভাদ্র মাসে পালন করা হয় অনন্ত চতুর্দশী, আর হয় বলরামের রামলীলা উৎসব। পৌষ মাসের সংক্রান্তীর দিন বিশেষ জাঁকজমকের সাথে বলরামের বাহান্নভোগ উৎসব পালন করা হয়। দোলযাত্রার সময় পঞ্চম দোল এখানে উদযাপন করা হয়। মাঘ মাসের উৎসবতো শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে।

এই মন্দির কত বছরের প্রাচীন তা নির্দিষ্ট করে বলা যায়না। তবে কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে এই গ্রাম ও মন্দিরের কথা উল্লেখ আছে। তিনি ছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর কবি। পঞ্চদশ শতাব্দীর কবি মালাধর বসুর শ্রী কৃষ্ণবিজয় কব্যেও এই বলরাম মন্দিরের উল্লেখ আছে। আবার কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে এই মন্দির স্থাপিত হয়েছিল পাল যুগে। অন্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন সেন যুগে এই বলভদ্র মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নির্দিষ্ট লিখিত ইতিহাস না থাকলেও এই বিগ্রহ ও মন্দির যে খুবই প্রাচীন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল নানা ধর্ম, নানা ধারা আর নানা সংস্কৃতির মেল বন্ধন বাংলার অন্যতম এই প্রাচীন বলরাম দেবের মন্দির। আর শ্রীকৃষ্ণ ও জগন্নাথ ও সুভদ্রা ব্যাতিত বলরাম বা বলভদ্র জীউ একক ভাবে বিরাজ করছেন এরকম মন্দির বিরল।

%d bloggers like this: