কিশলয় মুখোপাধ্যায়: সময়টা ১৯২৩-২৪ সাল। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে দেওয়া থাকতো একটি মাটির পাত্র। বাড়ির সদস্যদের অনুরোধ থাকতো প্রতিদিন সেই পাত্রে একমুঠো চাল রেখে দেয়। সপ্তাহের শেষে সমিতির সদস্যরা সেই চাল একসঙ্গে সংগ্রহ করে ব্যাবহার করতেন জনকল্যানে। এই ভাবে সমাজসেবায় পথ চলা শুরু গুড়াপ পল্লী সমিতির। সমাজ সেবার পথে চলতে চলতে আজ একশ বছর অতিক্রান্ত করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। শতবর্ষ উপলক্ষে বিগত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শতবর্ষ উদযাপন উৎসব পালন করেছে পল্লী সমিতি যা শুরু হয়েছিল বাইক রেলির মাধ্যমে। গুড়াপ পল্লী সমিতি এই একশো বছর কে কেন্দ্র করে গত ২১,২২ ও ২৩ জানুয়ারি তিনদিন মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। ১৯২২ সালে ইংরেজ শাসনের সময় গ্রামের পরিবেশ শান্ত ধীর স্থির থাকলেও লোকের মন ছিল অশান্ত আর অস্থির। ইংরেজ শাষকদের ও কিছু জমিদারদের গ্রামবাসীদের জীবনোন্নয়নের প্রতি ছিল উদাসিন। সেই সময় গ্রামে গ্রামে সংগ্রাম শুরু হয় পল্লীবাসীদের জীবন ও যাপন উন্নয়নে। স্বাস্থ খাদ্য শিক্ষার মান উন্নয়নে। যথারীতি সেই সংগ্রামের আঁচ পড়ে হুগলি জেলার গুড়াপ গ্রামেও। ললিত মোহন ভট্টাচার্য, হৃষিকেশ চট্টোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সচ্চিদানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রমথনাথ নন্দী ও ভূষণ চন্দ্র পাল এই ছয় জন অদম্য মনোবল আর ইচ্ছাশক্তির জোরে ১৯২৩ সালের ১০ জুন প্রতিষ্ঠা করলেন গুড়াপ পল্লী সমিতি। প্রথম কর্মসূচি ছিল পথ ও পুকুরগুলোকে ব্যবহারযোগ্য করা। পল্লী সমিতির প্রথম সভাপতি হলেন সবার প্রিয় স্যার ও অঙ্ক বই লেখক কেশব চন্দ্র নাগ আর সম্পাদক হলেন ললিত মোহন ভট্টাচার্য।
অনুষ্ঠান শুরু হয় ২১ তাড়িখ সকালবেলায় প্রভাত ফেরীর মাধ্যমে। শীতের সকালে প্রভাত ফেরীতে ছিল মানুষের উৎসাহ। এরপর বামনা শ্মশানে নবনির্মিত শবদাহ আচ্ছাদন ও বিশ্রাম কক্ষ উদ্বোধন হয়েছে। সন্ধ্যায় স্মারক গ্রন্থ প্রকাশের পাশাপাশি বর্ণমালা লোকো সঙ্গীত ব্যান্ডের গানের আসর। প্রচুর দর্শক সমাগম হয়েছিল এই সঙ্গীতানুষ্ঠানে। পরেরদিন রবিবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বাঁশবড়িয়া বৃশ্চিক নাট্যদল পরিবেশন করলেন নাটক আঁধি। আর ছিল ছৌ নাচ। পুরুলিয়ার হুড়া গোষ্ঠী পরিবেশন করেছিলেন অসাধারণ ছৌ নৃত্য। বা়লার গর্ব এই ছৌ নাচ। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল সমিতি যেসব সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজ করেছিল সেই প্রতিযোগিতার বিজয়ী প্রতিযোগীদের পুরুষ্কৃত করা হল। আর শেষ দিন অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল অবশ্যই পল্লী সমিতির সদস্যদের অভিনিত নাটক চিত্ত বিনিময়। এছাড়া গান, আবৃত্তি, দেশাত্মবোধক নৃত্য প্রভৃতি অনুষ্ঠান তো ছিলোই। এই তিনদিনের অনুষ্ঠান দেখতে অনেক দর্শক এসে ছিলেন।
সমাজ সেবার সলতে পাকানো শুরু করেছিলেন কেসি নাগ ও চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সেই ১৯১২-১৩ সাল থেকে। অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন স্বামী বিশুদ্ধানন্দ বা জীতেন মাহাজারের কাছ থেকে। তিনি ছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের অষ্টম অধ্যক্ষ ও এই গ্রামেরই মানুষ। বিক্ষিপ্ত ভাবে কাজ হচ্ছিল তারপর একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন ওই ছয়জন।গ্রামের স্কুল রমনীকান্ত ইনিস্টিটিউটসন, মেয়েদের স্কুল শীতল কুমার বালিকা বিদ্যালয়, মাতৃসদন, গুড়াপের শতবর্ষ প্রাচীন বাজার, পশু চিকিৎসা, সুরেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগার সহ আরো প্রতিষ্ঠান গঠনের পেছনে পল্লী সমিতির অবদান অনেক।
পল্লী সমিতি খেলাধুলো প্রসারের জন্য ১৯৪৬ সালে শুরু করেছিল লক্ষণ চন্দ্র মেমোরিয়াল চ্যালেঞ্জ শীল্ড ও সত্য চরণ চ্যালেঞ্জ কাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা। প্রথম বছরে কামারকুন্ডু বি দল বাকসা স্পোর্টিং ইউনিয়ন কে হারিয়ে এই প্রতিযোগিতা জয়লাভ করে। সেই দিন অতিথি রূপে উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত ফুটবলার গোষ্ঠপাল ও উমাপতি কুমার। এর সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হল গুড়াপ পল্লী সমিতি ফুটবল ক্লাব এবং রেফারি অ্যাসোসিয়েশন। এছাড়া স্বাস্থ্য চর্চার জন্য ব্যায়ামাগার। এই ‘স্পোর্টস কালচার’ কে সামনে রেখে শতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল কেসি নাগ মেমোরিয়াল ফুটবল প্রতিযোগিতা ও মহিলা ফুটবল প্রদর্শনী। ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বার ২০২২ সালে এই ফুটবল খেলা হয়। ৭ জানুয়ারি হল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। পরেরদিন হল ভলিবল ও টেনিকয়েট প্রদর্শনী। আর সন্ধ্যায় হল দেহসৌষ্ঠব যোগাসন প্রতিযোগিতা। আর সবশেষে হল ১৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হল ক্রিকেট প্রতিযোগতা। স্বাস্থ্য চর্চার সঙ্গ সঙ্গে মনেয চর্চা ও সাংস্কৃতিক চর্চা হবেনা এটা হতে পারেনা।
১৯৪৮ সালে ২৩ অক্টোবর দুটি নাটক দুই পুরুষ ও টিপু সুলতান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গঠিত হল প্রমোদ বিভাগ। ১৯৭০ সাল নাগাদ এটা বন্ধ হয়ে গেলে পুনরায় রূপায়ন প্রতিষ্ঠা করে সাংস্কৃতিক চর্চা অাজও অব্যাহত। এই ‘মন চর্চা’ উপলক্ষে শতবর্ষ কমিটি ১৮ ডিসেম্বর নাচ গান সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা এবং ৪ জানুয়ারি অঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল।
আরো দুটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যা অতীত কালে ছিল। একটি হল সমবায় ব্যাঙ্ক ও অপরটি হল বিজয়া সন্মীলনী। ১৯২৪ সালে বিজয়া দশমীর দিন গ্রামের সমস্ত দুর্গা প্রতিমা আসতো। পুজো কমিটির সদস্যরা করতেন কোলাকুলি , থাকতো নাড়ু সহযোগে সামান্য আয়োজন।
একশো বছরে সমিতির কর্মকাণ্ডে অনেক অক্লান্ত সদস্যদের নাম অনুল্লিখিত রয়ে গেল। আসলে অংকের ভাষায় বলা যায় গুড়াপ পল্লী সমিতি= গুড়াপ বাসী। সুতরাং প্রত্যেকে গুড়াপ গ্রামবাসী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সমিতির কাজের সঙ্গে যুক্ত। অতীতে তো বটেই এখনও গুড়াপ গ্রামের ‘ব্যাকবোন’ বলা যায় গুড়াপ পল্লী সমিতিকে।