মিমি: কিশোর কুমার একটা যুগ। তিনি ছিলেন প্রকৃতই ভারতীয় সংগীত দুনিয়ার এক অবিস্মরণীয় কালজয়ী জ্যোতিষ্ক। যার প্রকৃত নাম ছিল আভাস কুমার গাঙ্গুলী। আজ সংগীতের এই দেবতার শুভ আবির্ভাব দিবস। কিশোর কুমারকে আমরা বারে বারেই ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখতে পেয়েছি। কর্ম ক্ষেত্রে তিনি যেমন সাফল্যের চূড়াকে চুম্বন করেছিলেন, ব্যাক্তিগত জীবন ছিল ততই বর্ণময় ও টানাপোড়েনের মিশেল। একজন অসামান্য গায়ক হওয়ার পাশাপাশি তিনি গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্য লেখক এবং প্রযোজক। এককথায় বলা যায় এমন প্রতিভাবান মানুষ সত্যিই খুব কম দেখা যায়। ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বাধিক সফল ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্লে-ব্যাক গায়ক হিসেবে তিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন লক্ষ মানুষের মনের মনিকোঠায়। আজ আমরা আমাদের এই অতি পরিচিত কিশোর কুমারের অন্য দিক একটা দিক সম্পর্কে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। আমরা অনেকেই জানি না কিশোর বাবু ছিলেন একজন অসম্ভব কৌতুক প্রিয় মানুষ। কিশোরের জীবনে ঘটে যাওয়া নানা ধরনের বিচিত্র কাহিনী রয়েছে। যার তালিকাটা অনেক লম্বা। সেই লম্বা তালিকা থেকে বেছে বেছে কয়েকটা ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম মাত্র।
১) কিশোর কেন মুম্বাইতে এলেন সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বরাবরই কিশোরীয় স্টাইলে বলতেন, “আরে, আমার দাদা অশোক কুমার তো এখানকার হিরো ছিল। আমি তো দাদার কাছেই এসেছিলাম। এরা তো সবাই আমাকে ধরে বেঁধে নায়ক করে দিল। দাদার সঙ্গে বোধহয় কী একটা ছবি ‘শিকারি’ হবে বোধহয়। সেইটাতে অভিনয় করার পর থেকেই অনেকে আমাকে অভিনয় করতে বলে। আর আমিও পালিয়ে বেড়াই। শেষমেশ দাদা জোর করে ‘আন্দোলন’ নামে একটা ছবিতে নায়ক করে দিল আমায়।” চলচ্চিত্রে কোনোদিনই সিরিয়াস হননি কিশোর। ইচ্ছে করেই গোলমাল বাঁধিয়েছেন মাঝে মাঝেই। কখনো ক্যামেরার সামনে ভুল সংলাপ বলেছেন, কখনো অকারণে হেসেছেন, আবার কখনো ডিগবাজি পর্যন্ত খেয়েছেন।
২) গৃহস্থ লোকের বাড়ির ফটকের সামনে লেখা থাকে ‘কুকুর হইতে সাবধান’। কিন্তু কিশোর কুমার তাঁর ওয়ার্ডেন রোড অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে একটি ফলক টানিয়ে লিখে রেখেছিলেন, ‘বিঅ্যাওয়ার অব কিশোর’। একদিন পরিচালক এইচ.এস.রাওয়াল সেই ফলক না দেখেই সোজা তাঁর বাড়িতে ঢুকে যান। আসলে কিশোরের থেকে ধার নেওয়া কিছু টাকা শোধ করতেই তিনি তাঁর বাড়িতে আসেন। টাকা ফেরত দেওয়ার পর রাওয়াল সাহেব যখন করমর্দনের জন্য তাঁর দিকে হাত বাড়ান, তখন কিশোর কুমার তাঁর হাতে কামড়ে দেন। পরে বলেন, “আপনি কি ফলকটি দেখে বাড়িতে ঢোকেননি?”
৩) কিশোর কুমারের এই ধরনের ক্ষ্যাপা স্বভাবের দরুন ব্যতিব্যস্ত হয়ে একবার এক পরিচালক প্রযোজকের কাছে অনুরোধ করেন, কিশোর যেন শুটিংয়ের সময় পরিচালকের নির্দেশ অমান্য করে কিছু না করেন। তারপর ওই পরিচালকের একটি শুটিংয়ে গাড়ি চালানোর দৃশ্যে পরিচালক কাট বলতে ভুলে যাওয়ায় কিশোর কুমার সোজা গাড়ি চালিয়ে খান্ডোলা চলে যান।
৪) ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ভারতে জরুরি অবস্থা চলাকালীন কিশোর কুমারকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ‘২০ পয়েন্ট প্রোগ্রাম’-এর প্রচার করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু তাতে তিনি রাজি না হবার কারণে তাঁকে অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং বিবিধ ভারতী থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
৫) নকল করতে ওস্তাদ ছিলেন কিশোর। ‘পড়োশান’ ছবিতে নিজের মাকে নকল করেন তিনি। চোখে কাজল পরে, লম্বা চুল পরে, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে, পান মুখে দিয়ে একটি দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন তিনি। তাঁর অভিনয় দেখার পর ছবিটির আরো দুই অভিনেতা মেহমুদ এবং সুনীল দত্ত নিজেদের অভিনয় কৌশলকে আরো সড়গড় করতে দুদিনের বিরতি নিয়েছিলেন। তা নাহলে কিশোরের অভিনয়ের কাছে তাঁদের অভিনয় কোনো স্থানই পেত না।
৬) একবার এক প্রযোজক কিশোর কুমারকে তাঁর প্রাপ্য অর্থের অর্ধেক দিয়ে বলেছিলেন, বাকি পাওনা ছবির কাজ শেষ হলে মিটিয়ে দেবেন। পরের দিন কিশোর কুমার অর্ধেক চুল কেটে এবং অর্ধেক গোঁফ কামিয়ে শুটিংয়ে এসে বললেন, পুরো টাকা না পাওয়া অবধি তিনি এভাবেই শুটিং করবেন।
৭) কলেজে পড়ার সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দর্শকদের সামনে দাঁড়িয়ে গান গাইতে রীতিমতো ভয় পেতেন কিশোর কুমার। তাই তিনি কলেজের অনুষ্ঠানে পর্দার পেছনে দাঁড়িয়ে গান গাইতেন। শোনা যায়, তিনি কলেজ ছেড়ে আসার সময় কলেজ ক্যান্টিনে পাঁচ টাকা ধার করে রেখেছিলেন। সেখান থেকেই নাকি পরবর্তীতে তিনি লিখেছিলেন তাঁর সেই বিখ্যাত গান, “পাঁচ রুপাইয়া বারো আনা”।
৮) কিশোরের দাদা অশোক কুমার নিজেই বলতেন, ছোটবেলায় ওর গানের গলা খুবই খারাপ ছিল। কাঁদতে কাঁদতেই হঠাৎ করে একদিন ওর গলা ঠিক হয়ে যায়। কারো কাছে গান শেখেননি কিশোর। অথচ ভারতীয় গানের জগতে তিনি পেয়েছেন সর্বোচ্চ সম্মান। লতা মঙ্গেশকর বলেছেন, ‘গানের জগতে আমি একমাত্র ভয় পেতাম কিশোরকেই। গাইতে গাইতে সরগমে কোথায় কী করে দেবে, আমি মুখ থুবড়ে পড়ব।’
৯) চারবার বিয়ে করেছেন কিশোর কুমার। প্রথম বিয়ে এক বাঙালি মেয়েকে। নাম রুমা গুহ ঠাকুরতা। কিশোর কুমার গাঙ্গুলির মধ্যে বাঙালিয়ানা ছিল ভরপুর। রুমার সঙ্গে আট বছরের বিবাহিত জীবন ছিল তাঁর। সেই সময়েই ছেলে অমিতের জন্ম হয়। এর পরেই কিশোর প্রেমে পড়েন মধুবালার। ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ বা ‘ঝুমরু’ সিনেমায় অভিনয় করতে করতেই এই প্রেম। এই প্রেম জানতে পেরেই কিশোরের কাছ থেকে নীরবে সরে এসেছিলেন রুমা। আশ্চর্য বিষয় ছিল, মধুবালার মৃত্যু আসন্ন জেনেও (মধুবালার হার্টে যে রোগ ছিল তাকে বলে ভেন্টিকুলার সেপটাল, যে রোগে সেই সময় একলাখে একজন বাঁচত অপারেশনে) তাঁকে বিয়ে করেছিলেন কিশোর। মধুবালার মৃত্যুর পর কিশোরের তৃতীয় স্ত্রী যোগিতা বালি। এই বিয়েও বেশিদিন টেঁকেনি। সবশেষে বয়সের অনেক তফাত সত্ত্বেও কিশোর বিয়ে করেন তরুণী লীনা চন্দ্রভাকরকে। আশ্চর্য হলেও সত্যি, সারা জীবন কিশোর তাঁর জীবন সঙ্গিনী বেছেছেন সংগীত জগৎ থেকে নয়, অভিনয় জগৎ থেকেই। অথচ সেই অভিনয় জগৎটাই কিশোরের অসহ্য মনে হতো। অভিনেতা কিশোরকে কিশোর কোনো সময়ই সহ্য করতে পারতেন না। কোনো নকল জগৎ ছিল তাঁর কাছে অসহ্য।
১০) কিশোর ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী। একবার সত্যি সত্যি কিশোর মুম্বাইয়ে তাঁর বাড়ি গৌরীকুঞ্জের চারধারে খাল কাটতে শুরু করেছিলেন। বলেছিলেন, “আমার বাড়ির চারধারে থাকবে জল, যেখানে নৌকা ভাসবে, খান্ডোলার প্রকৃতিকে আমি নিয়ে আসব মুম্বইয়ে গৌরীকুঞ্জের চারধারে।” অবশ্য শেষপর্যন্ত মুম্বাই মিউনিসিপ্যালিটির সক্রিয় হস্তক্ষেপে কিশোর ওই কাজ করে উঠতে পারেননি। ১৯৮৭ সালের ১৩ই অক্টোবর কিশোর কুমার মারা যান। কিশোরকে নিয়ে যাওয়া হয় খান্ডোলায় তাঁর জন্মভূমিতে, তাঁর প্রিয় শহরে। এই কিংবদন্তিকে তাঁর জন্মদিনে প্রণাম। ভারতীয় ছবির অন্যতম সেরা এন্টারটেইনারকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।