Site icon Sambad Pratikhan

চল্লিশ ধারার জল দিয়ে দেবীর দর্পণ স্নান করানো হাওড়া শিবপুরের সাধুখাঁ বাড়ির ২০০ বছরের পুজো

Advertisements

বেশ কিছু বছর ধরে বনেদি বাড়ির পূজা দেখা নিয়ে লোকের মধ্যে উত্‍সাহ বেড়েছে। এমনকি বিদেশ থেকেও অনেকে আসেন বনেদি বাড়ির পূজা দেখতে। বনেদি বাড়ির পূজার মধ্যে যেগুলো খুব বেশি পরিচিত সেগুলো নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমও কিছুটা হলেও আগ্রহ দেখায়। এর সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য পর্যটন দপ্তর ও রাজ্য, দেশ ও বিদেশের বহু পর্যটকদের এই সকল বনেদি বাড়িগুলির পূজা দেখাতে নানা ব্যবস্থা নেন। দল বেঁধে প্রচুর দর্শনার্থী ও ফটোগ্রাফার এসব বাড়িতে এসে ভিড় করেন। এর মধ্যে কিছু বাড়ি আছে যেগুলোর পূজা অনেক প্রাচীন এবং তাঁদের পূজার ইতিহাসও খুব চিত্তাকর্ষক, কিন্তু অনেকেই তাঁদের বাড়ির পুজো সাথে পরিচিত নয়। এরকম একটি বাড়ির পুজোর সুলুক সন্ধানে সংবাদ প্রতিখনের প্রতিনিধি- জয়শ্রী সাধুখাঁ: 

হাওড়া শিবপুরের সাধুখাঁ বাড়ি। আজ থেকে ২০০ বছর আগে যে পুজোর সূত্রপাত সেই সাধুখাঁ পরিবার তাঁদের পুজোর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আজও সকল রকম রীতি-নীতি, নিয়ম-কানুন, ঐতিহ্য বজায় রেখে মাতৃ আরাধনা করে চলেছেন নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে। সবথেকে উল্লেখযোগ্য আজ অবধি কখনও কোন রকমের বাধা পড়েনি এ পুজোয়। শোনা যায়, স্বপ্নাদেশেই এই পরিবারের রাসমণি (সাধুখাঁ) দেবীর শাশুড়ি মা এই পুজো শুরু করেছিলেন এবং তিনি দুধ, ঘুঁটে এবং ঘানির তেল বিক্রি করেই সেই পুজো বজায় রেখেছিলেন। এটাও শোনা যায়, একবছর অসুবিধার কারণে পুজো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে তিনি স্বপ্নাদেশ পান কুমোরটুলিতে মা রয়েছেন, সেখান থেকে যেন মাকে মন্দিরে আনা হয়। রথ কিম্বা উল্টো রথের দিন নিয়ম মেনে সাধুখাঁ বাড়িতেই করা হয় কাঠামো পুজো। একটি গড়ান কাঠ মন্ত্রপাঠ ও নিষ্ঠা সহকরে ব্রাহ্মণ দ্বারা পুজো করা হয়। সেই কাঠ মা দুর্গার কাঠামো তৈরী করার সময় দেওয়া হয়। এরপর খড় দিয়ে ঠাকুরের অবয়ব তৈরী হয়। সাধুখাঁ বাড়ির ঠাকুরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এক চালার সাবেকি ঘরানায় মা মহিষাসুরমর্দিনী তাঁর সন্তানদের সাথে বিরাজমান। দেবীর বাহন সিংহের রঙ ধবধবে সাদা।  প্রতিমার গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল হলুদ। একচালার প্রতিমায় গণেশ, সরস্বতী অন্যদিকে লক্ষ্ণী এবং কার্তিক থাকে। গণেশের পাশেই থাকে নবপত্রিকা।

মহালয়ার পর দিন প্রতিপদ। এই পরিবারের রীতি অনুযায়ী ওদিনই দেবী দুর্গার ঘট স্থাপন করা হয় মন্দিরে। সেখানেই চলে পুজো। এর সঙ্গে প্রতিপদ থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত সাবেকি রীতি মেনে একটি বেলগাছ এবং মনসা গাছকে দেবী হিসাবে পুজো করা হয়ে থাকে। এসময়ে প্রতিদিন চণ্ডীপাঠ হয়। ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় মাকে অলংকার এবং অস্ত্রে সুসজ্জিত করে বোধন শুরু হয়।

এই বাড়ির পুজোর রীতি সপ্তমীর দিন বাড়ির ছেলের কাঁধেই নবপত্রিকা গঙ্গাস্নানে যান এবং প্রতিমার সামনে ঘট স্থাপন করা হয়। এই বাড়ির পুজোর বিশেষ আকর্ষণ সন্ধি পুজো। সন্ধি পুজোয় পাঁঠা বলির প্রচলন আছে। এরপর ১০৮ প্রদীপ জ্বালানো হয়, ১০৮ পদ্মফুলে মায়ের পুজো হয় এবং বাড়ির যিনি কর্তা বা কত্রী পুজোয় বসেন তাঁর মাথায় এবং হাতে ধুনো পোড়ানো হয়। আগে সপ্তমীর দিন একটা, অষ্টমীর দিন একটা, নবমীর একটা এবং মানসিক করা পাঁঠা বলি হতো। কয়েক বছর থেকে সন্ধিপুজো বাদে পাঁঠা বলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন নবমীর দিন চালকুমড়ো, আখ, কলা, শসা এবং বাতাবী লেবু এই ৫টি ফল বলি দেওয়া হয়। কোনো মানসিক থাকলে পাঁঠা বলি হয়। এরপর কাদামাটি মেখে গঙ্গায় স্নান করতে যাওয়া হয়।

সাধুখাঁ বাড়ির পুজোয় দর্পণ স্নান এক বিস্ময়। চল্লিশ ধারার জল দিয়ে দেবীর দর্পণ স্নান করানো এই বাড়ির কঠোর নিয়ম। কোনও বছরই তা লঙ্ঘন হবে না বা হয় না। মানস সরোবর, শতুদ্রু, গঙ্গোত্রী, পুষ্কর, চিল্কা, তিস্তা, তোর্সা-সহ চল্লিশ রকমের নদী, সমুদ্র, হ্রদ, ঝর্ণা থেকে জল সংগ্রহ করে সেই জলে দেবীর দর্পণ স্নান হয়।

দশমীর দিন আয়নায় মায়ের চরণ দেখে সিঁদুর খেলা শুরু হয়। এরপর প্রতিমা বরণের পর দেবীর মুখে মিষ্টি জল দিয়ে কানে কানে বলা হয় “সামনের বছর আবার এসো মা”। পারিবারের বিশ্বাস, এর ফলে আগামী বছরে ঘরের মেয়ে দুর্গা নিশ্চই আসবেন। এরপর জলে সাত পাক ঘুরিয়ে মাকে জলে নিমজ্জিত করা হয়। তারপর কাঠামো মন্দিরে রেখে শান্তি জল ছিটিয়ে বিজয়া দশমীর কোলাকুলি, প্রণাম সেরে সকলকে মিষ্টি প্যাকেট দিয়ে বিদায় জানানো হয়।

 

Exit mobile version