Site icon Sambad Pratikhan

মোহিনী ডুয়ার্স-ডুয়ার্স ভ্রমণ দ্বিতীয় পর্ব

Advertisements

সৌরভ মুখোপাধ্যায়: প্রথম পর্বে আমাদের যাত্রাপথের সংক্ষিপ্ত বিবরণী টা আর একবার দিয়ে দি। প্রথম পর্বে আমাদের যাত্রা ছিল কুচবিহার রাজবাড়ী মদনমোহন মন্দির। তারপরে চিলাপাতা অরণ্য এবং খয়রাবাড়ি জঙ্গল। চিলাপাতার ঘন জঙ্গলে একজন মাত্র গজরাজ এবং খয়রাবাড়ি ব্যাঘ্রালয় পর্ব শেষ। মনের মধ্যে ক্রমাগত দুন্দুবি বেজে চলেছে আগের পর্বের এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতাকে সাক্ষী করেই তারপরদিন প্রাতরাশ সেরেই আবার বেরিয়ে পরা গেল অজানাকে জানতে অচেনাকে চিনতে। আজকের গন্তব্য বজ্র ড্রাগনের দেশ অথবা ভুটান। কিন্তু অনেকর মধ্যেই প্রশ্ন উদয় হতে পারে আরে মশাই “ভুটান” সে তো পরদেশ।  কিন্তু ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ সেতো আর নিছক মিছে কথা নয়। তাই প্রকৃতিদেবী শুধু জঙ্গল উপহার দেননি তার সাথে দিয়েছেন গিরিরাজ হিমালয়। এই সুবিশাল হিমালয়ের পূর্বাংশে অবস্থিত ছোট্ট একটি প্রতিবেশী দেশ ভুটানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ফুন্টসলিং তার একটি হস্ত প্রসারিত করে রেখেছে আমাদের ভারতবর্ষ থুড়ি পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্স অঞ্চলে।

এই ফুন্টসেলিং শহরটি ভুটানের চুখা জেলার অন্যতম বাণিজ্য শহর ও ভুটানের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু বলা চলে। পাশাপাশি এই শহর ভারত-ভুটান সীমান্তের প্রবেশদ্বারও। অগত্যা তাকে উপেক্ষা কি করে করা যায় আর। সুতরাং সেই হস্তের একটা ছোট্ট হাতছানিতে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়ে গেল ভুটানের ফুন্টসেলিং এর উদ্দেশে। এখানকার অন্যতম দর্শনীয় স্থান ভুটান গেট (ভারত ভুটানের প্রবেশদ্বার) জ্যাংটোপেলরি বুদ্ধ মন্দির,  কার্বন্দী মোনাস্ট্রি এবং কুমির প্রকল্প। এখানে কোনো বিমানবন্দর না থাকায় বর্তমানে ভুটান সরকার তোর্সা নদীর একটা অংশে বিমানবন্দর করছেন।

 ভুটান পর্বের পর থেকে:  ভুটানের ভুসৌন্দর্য উপভোগ করে তাকে অলভিদা জানিয়ে আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলাম মানে আবার আমাদের পুণ্যভূমি তথা মাতৃভূমি ভারতবর্ষে তথা পশ্চিমবঙ্গে। এবারের গন্তব্য রাজাভাতখাওয়া- বক্সা-জয়ন্তী। এবারে কিন্তু শুধু বায়োলজির কচকচানি বা শুধু রক্তচক্ষু দেখানো অতীতের ইতিহাস নয়। এবারের গন্তব্যে অতীতের ইতিহাসের সাথে মিশেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য তার সাথে সমানভাবে পাল্লা দিয়ে ছুটে  চলেছে আদিম মহাদ্রুম।

প্রসঙ্গত একটা কথা ছোট করে এখানে বলে রাখা দরকার, রাজাভাতখাওয়া নামকরণের কারণ ও সার্থকতা। ব্রিটিশ যুগে কুচবিহারের রাজা ধৈর্যেন্দ্রনারায়ন ও ভুটানের রাজার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের তরাই অঞ্চলের দখলদারি নিয়ে প্রচন্ড যুদ্ধ হয় ও রাজা ধৈর্যেন্দ্রনারায়ন গ্রেপ্তার হন। এরপর ব্রিটিশ রাজ্যের মধ্যস্থতায় কুচবিহারের রাজা ছাড়া পেলে ভুটান থেকে ফেরার পর এই স্থানে রাজার জন্য প্রথম অন্নগ্রহন ব্যবস্থা করা হয়। তারই ফল স্বরূপ জায়গাটা রাজাভাতখাওয়া নামেই বিখ্যাত।

দর্শনীয় স্থান:  বক্সা জঙ্গলের প্রবেশপথে গাড়ি থেকে নেমে এন্ট্রি ফি দিয়ে প্রথমে রাজাভাতখাওয়া সংগ্রহশালা দেখে নিন (ভিতরে বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রাণীর মৃতদেহ সংরক্ষিত আছে। কিন্তু ছবি তোলা মানা বলে দিতে পারা গেল না) দেখে নিয়ে জঙ্গলের রাস্তা ধরে চলে যাওয়া যায় বক্সা ফোর্ট আর জয়ন্তী নদীর পাড়ে। কথিত আছে বক্সা ফোর্ট আগে একসময় ব্রিটিশ শাসিত জেলখানা ছিল যেখানে নাকি নেতাজি কয়েকদিন বন্দি ছিলেন। বক্সা ফোর্ট দেখতে আড়াই কিলোমিটার ওপরে উঠে তারপর দেখতে হবে। কিন্তু সময়ের অভাবে সে যাত্রা আমাদের বাতিল করতে হলো। তাই অগত্যা আমরা পা বাড়ালাম জয়ন্তী নদীর উদ্দেশ্যে।

দেখা মাত্রই মনে হলো যেন সুন্দরী প্রকৃতি তার সমস্ত সৌন্দর্যের ডালা নিয়ে অপেক্ষারত। “জয়ন্তী মঙ্গলাকালী ভদ্রকালী কপালিনি দুর্গা শিবা ক্ষমাধাত্রী স্বয়া স্বীধা নমস্তুতে”- হয়তো শিব দুর্গা পার্বতী ক্ষমাধাত্রী কাউকেই পাইনি, কিন্তু যে জয়ন্তীকে পেয়েছি তাকে সহস্র কোটি প্রনাম। তিনি যে নিজের রূপে নিজেই মুগ্ধা। নিজের রূপে নিজেই বিচলিতা হয়ে ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন করছেন তার রূপ। যেন তাঁর এই কর্মকান্ডের সাক্ষী রাখার জন্যই তিনি তার কোলে ঠাঁই দিয়েছেন তার “চুনিয়া” রুপি কন্যাকে ও চুনিয়ার গর্ভে ধারণ করা কিছু বন্য জীবন্ত সন্তান সন্ততিদের। যারা সেখানে জন্মজন্মান্তর ধরে দাঁড়িয়ে বারংবার নির্বাক ভাবে সাক্ষী থাকছে জয়ন্তী সুন্দরীর বারবার এই পট পরিবর্তন। এই দৃশ্য দেখে বারবার একটাই কথা মনে আসছিল “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি”। কিন্তু ছুটে চলা জীবন যে স্থিতিশীল নয়। তার সাথে তাল মেলাতে অন্তবিহীন পথে চলাই জীবনকে মন্ত্র করে আবার ফিরে চলতে হলো নতুন কিছুর সন্ধানে নতুন কিছুর আশায় প্রকৃতির অনন্ত সুন্দরী রূপকে পিছনে ফেলে মনের মণিকোঠায় বন্ধক রেখে।

 ডুয়ার্স ভ্রমণ তৃতীয় পর্ব: এবারের গন্তব্য ডুয়ার্সের প্রাণভোমরার ভিতরে যার অন্যতম পোশাকি নাম জঙ্গল সাফারি। ডুয়ার্সের প্রাণভোমরাকে তিনটি আলাদা অঞ্চলে ভাঙা যেতে পারে জলদাপাড়া গরুমারা বা ডেনজং। তিনটিরই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে একে অন্যকে হার মানায়। দেখে সত্যি মনে হয় “জাঙ্গাল জাঙ্গাল বাত চালি হ্যায় পাতা চ্যালা হ্যায়”। যাই হোক তিনবারের কঠিন প্রচেষ্টার পর দীর্ঘ সময় ধরে তীর্থের কাকের মতো জলদাপাড়া (আমাদের জলদাপাড়া সাফারি করার কথা ছিল তাই পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক শুধু জলদাপাড়া সাফারি করি) টিকিট কাউন্টারে দাঁড়ানোর পর সফলভাবে সাফারির অনুমতিপত্র জোগাড় করা গেল।

এই প্রসঙ্গে সবার জন্য একটা কথা বলা দরকার জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে সারাদিনে দুবার দুটো করে মোট চারবার সাফারি হয়। একবার হয় সকালবেলা ৫-৩০ থেকে আর একবার হয় সকাল ৭-৩০ থেকে। যার অনুমতিপত্র দেওয়া হয় আগেরদিন সন্ধে ছয়টা থেকে রাত ৮-০০ পর্যন্ত। আর একবার সাফারি হয় দুপুর ৩-০০ থেকে এবং বিকেল ৫-০০ থেকে। প্রত্যেক সাফারির জন্যই বরাদ্দ একঘন্টা তিরিশ মিনিট করে। মোট কমবেশি কুড়ি থেকে পঁচিশ খানা জিপ আছে তাই জিপের সংখ্যা অনুযায়ী অনুমতি দেওয়া হয়।

একটা জিপে সর্বাধিক ছয় জন যাত্রী যেতে পারে। গাড়ি ভাড়া টিকিট বাবদ ভাড়া পড়বে গাড়ি পিছু দুহাজার চারশো টাকা আর একদম শেষের সফরিতে আরো মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকা(শেষ সাফারির বাড়তি হিসাবে দেখতে পাওয়া যায় সন্ধ্যে বেলায় স্থানীয় আদিবাসীদের নৃত্যানুষ্ঠান। তাই পঞ্চাশ টাকা করে বেশি লাগে)। দুদিক দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় একটি হলং নদীর পাশ দিয়ে আর একটি ট্রলি লাইন দিয়ে। ট্রলি লাইনে কিছু সেভাবে দেখার সম্ভাবনা কম। তাই হলং নদীর দিক দিয়ে  যাওয়ার চাহিদা বেশি থাকে।  এছাড়া হাতি সাফারিও করা যায়। হাতি সাফারির খরচ একটু বেশি আর সর্বাধিক চারজন যাত্রী পিঠে বসতে পারে।

আমাদের সাফারি ছিল হলং একদম শেষ সাফারিতে। এই জঙ্গল সাফারিতে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে গণ্ডার বুনো হাতি (যদি দেখা দিতে চান ওনারা তবেই) আর প্রচুর পরিমানে আমাদের জাতীয় পাখি ময়ূর এবং তাদের সঙ্গিনীকে। এছাড়া বাড়তি হিসাবে পাওয়া গেছে একটি গোসাপ একটি ঈগল পাখি। পথে যেতে যেতে যে সমস্ত বাসিন্দারা আমাদের দেখা দিলেন তার কিছু প্রতিকৃতিগুলো দেওয়া হলো। (ছবি – লেখক)

Exit mobile version